ফাইল চিত্র।
রাজপথে ট্র্যাফিকবিধি ভাঙিবার অপরাধে গাড়ি, বাস, বাইক থামাইয়া পুলিশ জরিমানা করিতেছে, ইহা পরিচিত দৃশ্য। অপরিচিত যাহা, তাহা হইল— খোদ পুলিশকেই আইন অমান্য করিবার অপরাধে জরিমানা করা হইতেছে। নাগরিক অভিজ্ঞতা হইল, গাড়িতে ‘পুলিশ’ কথাটি লেখা থাকিলেই যেন আরোহী আকাশে উড়িতে থাকেন। ‘পুলিশ’ লেখা গাড়ি নির্দ্বিধায় সিগন্যাল ভাঙিবে, পুলিশের বাইক বিধি উড়াইয়া যে কোনও রাস্তায় ছুটিবে— ইহাই যেন নিয়ম। পুলিশের সকলেই সমমনোভাবাপন্ন নহেন, সত্য। কিন্তু যাহা চোখে পড়ে তাহা এই রূপ— ট্র্যাফিক আইন ভাঙিবার জন্য সচরাচর পুলিশকে শাস্তি তো দূর, জিজ্ঞাসাবাদের মুখেও পড়িতে হয় না। অথচ, একই অপরাধ আমজনতা করিলে রক্ষা নাই। এই দ্বিচারিতার ‘সংস্কৃতি’তে সম্ভবত এই বার দাঁড়ি পড়িতে চলিয়াছে। লালবাজারের তরফে জানানো হইয়াছে, ট্র্যাফিক আইন ভাঙিলে পুলিশের গাড়ি বা পুলিশকর্মীর বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হইবে। অর্থাৎ, আইনরক্ষককেও আইন মানিয়া চলিতে হইবে বইকি।
উদ্যোগটি স্বাগত। অনুমান, এই বার্তার মধ্য দিয়া সাধারণের চোখে পুলিশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করিবার প্রয়াস লওয়া হইল। ট্র্যাফিক আইন মানিবার ক্ষেত্রে যে তাঁহাদের ভাবমূর্তি বিশেষ উজ্জ্বল নহে, তাহা শীর্ষকর্তারা অন্তত বুঝিয়াছেন। আইন সকলের জন্য সমান ভাবে প্রযোজ্য। জাত, বর্ণ, ধর্ম, লিঙ্গ, পদ— কিছুই আইনের ঊর্ধ্বে উঠিতে পারে না। আইনরক্ষককেই সেই কথাটি স্মরণ করাইতে উপরমহলের নির্দেশের প্রয়োজন পড়িল, ইহা সবিশেষ লজ্জার। পুলিশের কাজ শুধুমাত্র চোর-ডাকাত ধরা নহে। সমাজে যাহাতে আইনের শৃঙ্খলা রক্ষিত হয়, তাহা দেখাও তাঁহাদেরই দায়িত্ব। তাঁহারা যদি নিজেরাই সেই আইনের পরোয়া না করেন, তবে জনগণ মানিবে কেন? ইতিপূর্বে পুলিশের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে নানাবিধ পদক্ষেপ করা হইয়াছে। কোথাও পুলিশকর্মীরা ফুটবল খেলিয়াছেন, কোথাও শিশুবান্ধব থানা স্থাপিত হইয়াছে, লকডাউনে তাঁহারা গান গাহিয়া ঘরে থাকিবার প্রয়োজনীয়তা বুঝাইয়াছেন। এই সকলই সুন্দর উদ্যোগ। কিন্তু গোড়াটিতেই গলদ থাকিলে সকল উদ্যোগ গুরুত্বহীন হইয়া পড়ে। গলদটির প্রতি নজর পড়িতে যে এত বিলম্ব হইল, তাহা আশ্চর্যের।
তবে ভারতের ‘ঐতিহ্য’-এর প্রতি দৃষ্টি রাখিলে ইহাতে বিস্ময় জাগে না। ইহা ক্ষমতা প্রদর্শনের পথ— যে অভ্যাসটি শুধুমাত্র পুলিশের নহে, সমাজে প্রভাবশালীদের অনেকেরই মজ্জাগত। তাঁহারা মনে করেন— ক্ষমতা এবং অর্থ সকলই কিনিতে পারে, আইনও। সেই কারণেই মন্ত্রীর কনভয়ে অ্যাম্বুল্যান্স আটকাইয়া পড়ে, নেতার পুত্র চরম অপরাধ করিলেও শাস্তি পায় না। সম্প্রতি ক্ষমতার এহেন অপব্যবহারে রাজ্য, কেন্দ্র উভয় সরকারই রাশ টানিতে বাধ্য হইয়াছে। লালবাতির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হইয়াছে। ভিভিআইপি-দের ট্র্যাফিক আইন মানিবার উপর জোর দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু, প্রদীপের নীচের অন্ধকার ঘোচে নাই। আইন ভাঙিলে মন্ত্রীই হউন, অথবা পুলিশ, সকলেই সমান শাস্তি পাইবার যোগ্য— এই নিয়ম কড়া ভাবে প্রতিষ্ঠিত না হইলে সমাজ বিশৃঙ্খল হইবে। দুর্নীতি, অপরাধ বহু গুণ বৃদ্ধি পাইবে। সেই দিন না আসাই কাম্য।