মন্ত্রিমহোদয় বা তাঁহার পুত্র ষড়যন্ত্র করিয়া বিক্ষোভরত কৃষকদের হত্যা করিলেন কি না, তদন্ত সেই প্রশ্নের জবাব মিলাইবে, আশা করা চলে। উত্তরপ্রদেশে নির্বাচন কড়া নাড়িতেছে— নচেৎ পুলিশের খাতায় এত সহজে এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও তস্য পুত্রের নামে এমন গুরুতর অভিযোগ দায়ের হইত না। কিন্তু প্রশ্নটি কোনও নির্দিষ্ট ব্যক্তির অপরাধ প্রমাণ হওয়া বা তাঁহাদের শাস্তিবিধানের নহে। সেই প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ— গণতন্ত্রের স্বার্থেই গুরুত্বপূর্ণ— কিন্তু, তাহাই এই ক্ষেত্রে যথেষ্ট নহে। যে রাজনৈতিক পরিবেশ দেশ জুড়িয়া হিংস্রতা এবং হত্যাকে ‘বৈধতা’ দিয়াছে, এই মুহূর্তে তাহাকে প্রশ্ন করা প্রয়োজন। উত্তরপ্রদেশের লখিমপুর খেরির কথা বলিবার সময় অসমের দরং জেলার কথা বিস্মৃত হওয়া চলিবে না। অসমের কথা বলিবার সময় কাশ্মীরে সামরিক জিপের সম্মুখে বাঁধিয়া রাখা নাগরিকের মুখটি ভুলিলে চলিবে না; কাশ্মীরের কথা বলিবার সময় গোসন্ত্রাসীদের হাতে নিহত অগণন সংখ্যালঘুর যন্ত্রণাকে অস্বীকার করা চলিবে না; জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় বা জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার প্রহৃত ছাত্রছাত্রীদের কথা স্মরণে রাখিতে হইবে, ভোলা চলিবে না দেশের হরেক প্রান্তে অপমানিত, লাঞ্ছিত, ধর্ষিত দলিত নরনারীর মুখও। মনোহরলাল খট্টরের প্ররোচনার কথা যেমন স্মরণে রাখিতে হইবে, তেমনই ভোলা চলিবে না ‘আব্বাজানের সন্তান’দের প্রতি যোগী আদিত্যনাথের প্রকাশ্য বিদ্বেষ, নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীর কুকুরকে গাড়ি চাপা দিবার উপমা। গত সাত বৎসর ভারতের প্রান্তে-প্রান্তরে যাহা ঘটিয়া চলিতেছে, লখিমপুর খেরিতেও তাহাই ঘটিল। এই হিংস্রতা ভারতে কোনও অর্থেই ব্যতিক্রমী নহে, ইহা ‘অপর’-এর প্রতি রাষ্ট্র-অনুমোদিত আচরণ।
গত সাত বৎসর শিখাইয়াছে যে, গৈরিক বাহিনীর চোখে যাহাই অপর, তাহার প্রতি হিংস্র হইলে এই দেশে কোনও শাস্তি হয় না। নরেন্দ্র মোদীর ভারতে গণতান্ত্রিক নিরপেক্ষতার ভড়ংটুকুও আর নাই, ফলে শত্রু বাছিয়া তাহার নিধনে কোনও বাধা নাই। ইদানীং কৃষকদের বাড়া আর শত্রু কে? দেশের নাগরিকদের অহিংস, নিরস্ত্র প্রতিবাদের জবাব হিসাবে রাষ্ট্র দিয়াছে রণক্ষেত্র গড়িয়া। দিল্লির সীমান্তে যতখানি নিরাপত্তার ব্যবস্থা হইয়াছে, তাহা আন্তর্জাতিক সীমান্তকেও হার মানায়। অন্য দিকে, আইটি সেল নিরন্তর চেষ্টা চালাইয়াছে প্রতিবাদী কৃষকদের রাষ্ট্রদ্রোহী প্রতিপন্ন করিতে। কখনও তাঁহাদের খলিস্তানি জঙ্গি বলিয়াছে, কখনও পাকিস্তানের চর। মোট কথা, রাষ্ট্র হিসাবেই হউক বা দল হিসাবে, বিজেপি গণতন্ত্রের পথে কৃষকদের প্রতিবাদের সম্মুখীন হয় নাই— প্রতিবাদী কৃষকদের ‘অপর’ হিসাবে চিহ্নিত করিয়া রাখিয়াছে, আত্মজনের স্বীকৃতি দেয় নাই। ঠিক যেমন অসমের বঙ্গভাষী জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্র ‘অপর’ বলিয়া দাগাইয়া দিয়াছে। বিক্ষোভরত কৃষকদের উপর যে গাড়ি চালাইয়া দিয়াছে, অথবা পুলিশের গুলিতে মৃত (বা গুরুতর আহত) মানুষের দেহের উপর যে ব্যক্তি সোল্লাসে লাফাইয়াছে, তাহারা বিশ্বাস করিয়াছে যে, তাহারা রাষ্ট্রীয় কর্তব্য সম্পাদন করিতেছে— ‘অপর’-কে দমন করিতে রাষ্ট্রকে সাহায্য করিতেছে। প্রতিবাদী জনগোষ্ঠীর সহিত কী ভাবে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করিতে হয়, রাষ্ট্র সেই উদাহরণ তৈরি করিতে পারে নাই; সমানেই বিপরীত উদাহরণ রচনা করিয়া চলিয়াছে। ফলে, উত্তরপ্রদেশের ঘটনাক্রমে কোনও ব্যক্তিবিশেষকে অপরাধী চিহ্নিত করিয়া ভোটের খাতিরে তাহার শাস্তিবিধান করিলে তাহা নিতান্তই খণ্ডবিচার হইবে। এই অপরাধের প্রকৃত দায় দেশের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রকদের। এবং, প্রত্যক্ষ দায় যোগী আদিত্যনাথের সরকারের— রাজ্যটিকে তাঁহারা সর্বার্থেই আইনের শাসনহীন করিয়া তুলিয়াছেন। তাঁহাদের অপরাধ চিহ্নিত না হইলে হিংসার ধারা অব্যাহত থাকিবে।