আচ্ছাদন সরিতেছে ভারতের। সবুজ হইতে ক্রমশ ধূসর হইতেছে দেশ। মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকদের এক সমীক্ষা দেখাইতেছে, ২০০১ হইতে ২০২০ সালের মধ্যে ভারত প্রায় ২০ লক্ষ হেক্টর বৃক্ষ আচ্ছাদন হারাইয়াছে। এবং এই হার ভারতের উত্তর-পূর্বের সাতটি রাজ্যে সর্বাধিক। এই পরিসংখ্যান সবিশেষ উদ্বেগজনক, কারণ উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির বনাঞ্চল বহু বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির আবাসস্থল। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীববৈচিত্রপূর্ণ অঞ্চলগুলির মধ্যে উত্তর-পূর্ব ভারত অন্যতম। সুতরাং, এই সকল স্থানে অরণ্য আচ্ছাদন সরিয়া যাইবার অর্থ জীববৈচিত্রের বিপুল ক্ষতি। এবং শেষ পর্যন্ত তাহার প্রভাব হয়তো সারা ভারতের জীববৈচিত্রের উপরই অনুভূত হইতে চলিয়াছে।
তবে বিজ্ঞানীরা জানাইয়াছেন, ডিফরেস্টেশন অর্থাৎ অরণ্যচ্ছেদনের সহিত ট্রি কভার বা বৃক্ষ আচ্ছাদনের পরিমাণ হ্রাসের পার্থক্য রহিয়াছে। কৃষিকার্যের পর ফসল কাটা হইলেও উপগ্রহ চিত্রে তাহা বৃক্ষ আচ্ছাদন কমা হিসাবেই ধরা পড়ে। তদুপরি দাবানল, বন্যার ন্যায় নানাবিধ প্রাকৃতিক কারণেও দ্রুত সবুজ অন্তর্হিত হয়। সুতরাং, অরণ্য আচ্ছাদন হ্রাসের অর্থ যে শুধুমাত্র পরিকল্পিত ভাবে অরণ্য উচ্ছেদ— তেমন নহে। বস্তুত, উত্তর-পূর্বের অরণ্য আচ্ছাদন হ্রাসের প্রকৃত কারণ বুঝিতে হইলে আরও নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান প্রয়োজন। তবে কি এই সংবাদে উদ্বেগের কারণ নাই? বিলক্ষণ রহিয়াছে। বৃক্ষ আচ্ছাদনের পরিমাণ হ্রাসের পিছনে মানুষের প্রত্যক্ষ অবদান কতখানি, তাহা সুনির্দিষ্ট ভাবে না জানিলেও বলা চলে, সেই অবদান যথেষ্ট। বৃক্ষচ্ছেদ করিয়া আবাস গড়িয়া তোলা, নগরায়ণ-শিল্পায়ন— সবই ভারতের বাস্তব। উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে জুম চাষের প্রচলন আছে। সবুজের চাদর সরিয়া যাইবার ইহাও গুরুত্বপূর্ণ কারণ বইকি। উপরন্তু চাষবাস, পশুপালনের প্রয়োজনে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের গাছপালা কাটিয়া দেওয়া দাবানলের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে, যাহা আবার সবুজ চাদর সরিবার অন্যতম কারণ। সুতরাং, এই ক্ষতি রোধ করিতে হইলে সুচিন্তিত ভাবে বিকল্প চাষের পদ্ধতি স্থির করিতে হইবে, এবং স্থানীয় সম্প্রদায়গুলিকে অরণ্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বুঝাইতে হইবে।
তবে, সংরক্ষণের সদিচ্ছা আদৌ সরকারের আছে কি না, তাহা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আর্থ-সামাজিক কারণের পাশাপাশি এই অঞ্চলগুলিতে এবং ভারতের অন্যত্রও যে ব্যাপক বৃক্ষ ধ্বংসের কাজ চলিতেছে, তাহা কোনও ভাবেই উপেক্ষা করিবার বিষয় নহে। অসমে ৬৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ ইস্ট-ওয়েস্ট করিডর নির্মাণের জন্য প্রায় দেড় লক্ষ গাছ কাটা হইয়াছিল। একই অবস্থা অন্য পার্বত্য অঞ্চলগুলিতেও। সড়ক, রেলপথ, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, জনবসতি নির্মাণের নামে পাহাড়ের সবুজকে নির্বিচারে ধ্বংস করা হইতেছে। অপূরণীয় ক্ষতি হইতেছে বাস্তুতন্ত্রের। উত্তর-পূর্বে প্রাকৃতিক ঘন অরণ্যভূমি উচ্ছেদ করিয়া তাহার জায়গায় পাম গাছের ন্যায় বাণিজ্যিক চাষাবাদ করিবার কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত সেই কারণেই তুমুল সমালোচিত। বৃক্ষ আচ্ছাদন হ্রাসের প্রভাব সরাসরি জলবায়ুর উপরে পড়ে। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, এই অঞ্চলে বিগত কয়েক বৎসরে আবহাওয়ার অস্বাভাবিক আচরণের কারণও হয়তো ইহাই। অবিলম্বে সতর্কতা প্রয়োজন।