Extortion

দায়বদ্ধ

এই রাজ্যে শিল্প স্থাপনের অলিখিত শর্তই হইয়া দাঁড়াইয়াছে সিন্ডিকেটের অন্যায় দাবির নিকট নিঃশর্তে নতিস্বীকার করা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০২১ ০৫:৪২
Share:

দশ বৎসর পূর্বে পশ্চিমবঙ্গে শাসনক্ষমতার পরিবর্তন ঘটিয়াছিল এক শিল্পমেধ যজ্ঞের মাধ্যমে। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম প্রশ্নে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের ভুলগুলি অনস্বীকার্য, কিন্তু ইহাও সত্য যে, শিল্প লইয়া তুমুল অনিশ্চয়তাকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁহার অনুগামীরা পরিচালিত করিয়াছিলেন নেতির খাতে। কাজেই, রাজ্যে নূতন শিল্প-সম্ভাবনা তৈরি করা যেমন শাসক হিসাবে তাঁহাদের কর্তব্য, তেমনই দশ বৎসর পূর্বের নেতির রাজনীতির ক্ষতিপূরণও বটে। রাজ্যে নূতন শিল্পোন্নয়ন পর্ষদ গড়িয়া মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং তাহার দায়িত্ব লওয়ায় আশা জাগে, বিলম্বে হইলেও সরকার সেই কর্তব্য সম্পাদনে আগ্রহী হইতেছে। বিভিন্ন দফতরকে একই ছাতার নীচে আনিবার ফলে লালফিতার ফাঁস শিথিল হইবে, দীর্ঘসূত্রতা কমিবে বলিয়া আশা করা যায়। বিনিয়োগকারীদের সব প্রয়োজন যদি একই জানলায় মিটিয়া যায়, তবে তাহা ব্যবসার ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করে। আরও গুরুত্বপূর্ণ হইল এই বার্তাটি যে, পশ্চিমবঙ্গ শিল্পের স্বার্থকে গুরুত্ব দিতেছে। এই রাজ্য সম্বন্ধে লগ্নিকারীদের প্রধানতম অভিযোগ এইখানেই ছিল। এবং, অভিযোগটি বাম আমল হইতে কার্যত অবিকল রহিয়া গিয়াছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি সত্যই রাজ্য, এবং তাহার প্রশাসন সম্বন্ধে এই নেতিবাচক ধারণাটি পাল্টাইতে পারেন, তবে পশ্চিমবঙ্গের উপকার হয়।

Advertisement

তবে একই সঙ্গে স্মরণে রাখা জরুরি যে, প্রশাসনিক দীর্ঘসূত্রতা বা রাজনৈতিক ঔদাসীন্য এই রাজ্যে শিল্পায়নের পথে বৃহত্তম বাধা নহে। আরও দুইটি বাধা রহিয়াছে, অবিলম্বে যাহার সুরাহা হওয়া প্রয়োজন। প্রথমটির নাম জমি। যে হেতু গত দেড় দশকে রাজ্য রাজনীতির উত্থান-পতনের কেন্দ্রে রহিয়াছে জমি, এবং যে হেতু কৃষিজমি অধিগ্রহণ রুখিবার প্রতিশ্রুতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক ভাষ্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, ফলে পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের প্রশ্নটি কার্যত নিষিদ্ধ। এই জট কাটাইতেই হইবে। কোনও শিল্পগোষ্ঠীর হইয়া জমি অধিগ্রহণ করিয়া দেওয়া সরকারের কাজ নহে। কিন্তু, জমির বাজারটি যাহাতে যথাযথ ভাবে চলিতে পারে, তাহা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। রাজ্যের কোথায় কোথায় অধিগ্রহণযোগ্য জমি আছে, তাহার মানচিত্র প্রস্তুত থাকা প্রয়োজন। জমির ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে আলোচনায় রাজ্য সরকার মধ্যস্থতার কাজ করিতে পারে। নাগরিকের স্বার্থরক্ষা যেমন সরকারের দায়িত্ব, তেমনই শিল্পের সুবিধাও দেখিতে হইবে— ফলে, রাজ্য সরকারের পক্ষেই নিষ্পক্ষ মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করা সম্ভব। সরকার যত দিন না এই দায়িত্বটি স্বীকার করে, তত দিন রাজ্যের শিল্প-সম্ভাবনা বিকশিত হওয়া দুষ্কর।

দ্বিতীয় বাধাটির নাম সিন্ডিকেট। এই রাজ্যে শিল্প স্থাপনের অলিখিত শর্তই হইয়া দাঁড়াইয়াছে সিন্ডিকেটের অন্যায় দাবির নিকট নিঃশর্তে নতিস্বীকার করা। তাহাদের নিকট হইতেই অন্যায্য মূল্যে নিম্নতর গুণমানের কাঁচামাল কিনিতে বাধ্য হওয়া, অযথা মজুরিতে শ্রমিক লওয়া— এই বিষয়গুলি যে শিল্পায়নের প্রক্রিয়ার পক্ষে অতি নেতিবাচক, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীও তাহা বিলক্ষণ জানেন। পশ্চিমবঙ্গে সিন্ডিকেট এমন মহাপ্রতাপশালী হইয়া উঠিল কেন, আপাতত সেই আলোচনার প্রয়োজন নাই— কিন্তু এই প্রতাপে রাশ না টানিলে বিনিয়োগকারীরা এই রাজ্য সম্বন্ধে সন্দিহান থাকিবেন। কারণ, সিন্ডিকেট শিল্পের ব্যয়ের ক্ষেত্রে যে অনিশ্চয়তা তৈরি করে, তাহা ভয়ঙ্কর। রাজ্যের শিল্প-সম্ভাবনাকে সত্যই পুনরুজ্জীবিত করিতে হইলে জমি ও সিন্ডিকেট নামক দুইটি বাধা দূর করা আবশ্যক। দুইটি কাজই কঠিন, সন্দেহ নাই— তাহাদের সহিত রাজনীতির প্রশ্নটি দুই ভাবে জড়িত। তবে, আশা করা চলে, মুখ্যমন্ত্রী যখন রাজ্যের শিল্প-সম্ভাবনার কথা ভাবিতেছেন, তখন এই সমস্যাগুলি দূর করিবার কথাও ভাবিবেন।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement