সুধী নাগরিক প্রশ্ন করিতে পারেন, ভোটারের যখন অধিকার আছে নিজের মত পাল্টাইবার— এত দিন যে দলকে সমর্থন করিয়াছেন, তাহার বিরুদ্ধে ভোট দিবার— তাহা হইলে জনপ্রতিনিধিদেরই বা সেই অধিকার থাকিবে না কেন? এত দিন যে দলের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করিতেন, এখন সেই দলকেই কেন উন্নয়নের ভগীরথ হিসাবে বাছিয়া লওয়া যাইবে না? অথবা, দলে থাকিয়া কাজ করা না গেলে অন্য দলে যোগ দেওয়া যাইবে না কেন? অধুনা পশ্চিমবঙ্গে এই প্রশ্নগুলি অতি গুরুতর হইয়া উঠিতেছে। কোন নেতা কখন কোন দলে আছেন, তাহা জানিতে হইলে অদূর ভবিষ্যতেই হয়তো গেছোদাদার সুলুকসন্ধানের হিসাব কষিতে হইবে। প্রশ্ন হইল, রাজনৈতিক নেতাদের এই হৃদয় পরিবর্তনকে সমাজ কী চোখে দেখিবে? বিজেপি ছাড়িয়া বাবুল সুপ্রিয় তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিতেছেন, এই ঘটনাক্রমকে রাজ্যবাসী কী ভাবে ব্যাখ্যা করিবেন? কয়েক মাস পূর্বেও যিনি প্রকাশ্যে, জোর গলায়, অনুশোচনাহীন ভাবে সংখ্যালঘু-বিদ্বেষের দলীয় তত্ত্ব প্রচার করিয়াছেন, আজ কি তাঁহাকে সম্প্রীতির প্রতীক হিসাবেই গণ্য করা বিধেয়? যে নেত্রীর বিরুদ্ধে কটুতম কথা বলিতে বাধে নাই, তাঁহার অনুগামী হওয়ার মধ্যে কি কোনও আত্মসঙ্কট প্রকাশিত হইবে? সন্ন্যাস লইবার পূর্বে নাকি পূর্বাশ্রম বিস্মৃত হওয়াই বিধেয়। দলবদলু নেতাদের ক্ষেত্রেও কি পূর্বাশ্রম একই ভাবে অগ্রাহ্য করা চলিতে পারে?
প্রসঙ্গক্রমে অন্য একটি প্রশ্নেও সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গ দুর্ভাবিত— এক দলের টিকিটে নির্বাচনে জিতিবার পর দল পাল্টাইলেও কি জনপ্রতিনিধির সেই আসনটি বজায় থাকিতে পারে? একটি উত্তর হইল, আইনসভায় সেই জনপ্রতিনিধির সদস্যপদ খারিজ হইয়া যাইবে কি না, তাহা স্পিকারের সিদ্ধান্ত। উত্তরটি আইনসিদ্ধ হইলেও যে তাহা নৈতিকতার মাপকাঠিতেও উত্তীর্ণ, তাহা নহে। যে হেতু ভারতীয় গণতন্ত্রের নির্বাচন ব্যবস্থায় প্রার্থী ও দলের প্রতি জনসমর্থন পৃথক করিয়া দেখা অসম্ভব, ফলে এক দলের হইয়া নির্বাচনে জিতিয়া অন্য দলে নাম লিখাইবার পরও সেই পদ ধরিয়া রাখিবার মধ্যে অনৈতিকতা অনস্বীকার্য। বাবুল সুপ্রিয় জানাইয়াছেন যে, আসানসোলের সাংসদপদ তিনি ত্যাগ করিবেন। কেহ স্মরণ করাইয়া দিতে পারেন যে, রাজনীতি ত্যাগ করিবার কথা ঘোষণার পর দেড় মাস কাটিয়া গেলেও সাংসদপদ তিনি ছাড়েন নাই। যত ক্ষণ না তিনি পদটি ছাড়িতেছেন— যত ক্ষণ অবধি তিনি বিজেপির নীতির ভিত্তিতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি— তত ক্ষণ অবধি তাঁহার দল বদলের সিদ্ধান্তকে নৈতিক বলিয়া দাবি করা মুশকিল।
প্রশ্নটি কোনও ব্যক্তিবিশেষকে লইয়া নহে— প্রশ্ন সামগ্রিক প্রবণতার। দলত্যাগের পশ্চাতে ঠিক কোন কারণ রহিয়াছে, তাহাও এই নৈতিকতার প্রশ্নটিকে প্রভাবিত করিবে। নির্বাচনে পালাবদল ঘটিতে পারে, এই আশঙ্কায় যাঁহাদের দলে দম বন্ধ হইয়া আসিতেছিল, এবং পালাবদল না ঘটায় যাঁহারা নূতন দলের ‘অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে মানাইয়া লইতে না পারিয়া’ ফের পুরাতন ঠিকানায় ফিরিতে চাহিতেছেন, তাঁহাদের এই আসা-যাওয়ার পালাকে নৈতিক বলিয়া চিহ্নিত করা মুশকিল। আবার, মন্ত্রিত্ব খোয়া যাওয়ায় কেহ মনের দুঃখে দল বদলাইলে তাঁহার সিদ্ধান্তের নৈতিকতাও একই রকম প্রশ্নযোগ্য। যে ক্ষেত্রে দল বদলের পশ্চাতে অবিমিশ্র ধান্দাবাজি প্রকট, তাহা অনৈতিক, এবং সাধারণ মানুষও এই অনৈতিকতাকে যে ভাল ভাবে নেন নাই, দলবদলুদের নির্বাচনী ফলাফল সেই কথাই বলিতেছে। ঘোড়া কেনাবেচার সংস্কৃতি, এবং অপর পারের ঘাস দেখিয়া ঘোড়ার স্বেচ্ছায় বেড়া টপকাইতে চাহিবার প্রবণতা— বঙ্গীয় জনাদেশ বলিতেছে যে, উভয়ই সম ভাবে বর্জনীয়। রাজনীতি আর আইপিএল-এ ফারাক থাকুক, তেমনই জনগণের বাসনা।