রাজনীতি সম্ভাবনার শিল্প। শিল্পকর্মের স্বাভাবিক নিয়মেই, রাজনীতির সম্ভাবনাকে গড়িয়া তুলিতে হয় এবং তাহা সহজ কাজ নহে। বিশেষ করিয়া রাষ্ট্রশক্তি যখন একটি আপাদমস্তক আধিপত্যবাদী দল বা শিবিরের করায়ত্ত, তখন তাহার প্রতিস্পর্ধী রাজনীতি গড়িয়া তুলিবার কাজটি যতটা জরুরি, ততটাই কঠিন। এবং তাহার জন্য যদি বিভিন্ন রাজ্য বা অঞ্চলের রকমারি রাজনৈতিক দলের সংহতি ও সমন্বয়ের প্রয়োজন হয়, তাহাদের নিজস্ব স্বার্থের মধ্যে যদি পারস্পরিক বিরোধ বা অ-সামঞ্জস্য থাকে, তাহা হইলে রাজনীতি নামক সম্ভাবনা-শিল্পটির দাবিও বহুগুণ বাড়িয়া যায়। প্রথম এবং প্রধান দাবি অবশ্যই ক্ষুদ্র স্বার্থ ছাড়িয়া বৃহত্তর স্বার্থের প্রতি দায়বদ্ধতার। এই দাবি কোনও বায়বীয় মহানুভবতার নহে, বরং বাস্তববোধের। তাহার কারণ, আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রের শাসকদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক সংগ্রামে বিরোধী শক্তিগুলি পারস্পরিক সমন্বয়ের ভিত্তিতে রাজনৈতিক বিকল্প সন্ধানের বৃহত্তর স্বার্থ সাধন করিতে পারিলে শেষ অবধি তাহাদের প্রত্যেকের মঙ্গল।
এই সমন্বয়ের কিছু উদ্যোগ সাম্প্রতিক কালে দেখা গিয়াছে। বিভিন্ন উপলক্ষে সংসদের ভিতরে ও বাহিরে বিভিন্ন দল একযোগে কেন্দ্রীয় শাসকদের অন্যায়ের প্রতিবাদে বিক্ষোভ জানাইয়াছে। কিন্তু ক্রমাগত দেখা গিয়াছে, সকল উদ্যোগই অসম্পূর্ণ এবং দ্বিধাজড়িত। অসম্পূর্ণ, কারণ শাসক শিবিরের বাহিরে থাকা বিভিন্ন দল প্রতিস্পর্ধার মঞ্চে আসে নাই, আসিলেও তাহাদের দায়সারা ভাবটি প্রকট। দ্বিধাজড়িত, কারণ বিভিন্ন দলের আচরণে বিভিন্ন অসঙ্গতি ও স্ববিরোধের নানা লক্ষণ মিলিয়াছে। তাহার ফলে সংশয় জাগিয়াছে, তাহারা কি সত্যই বিরোধী ঐক্য চাহে? চাহিলে, কতটা এবং কত দূর? পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলটিও এই সংশয়ের বাহিরে নহে। গত বিধানসভা নির্বাচনের সময়েই তৃণমূল কংগ্রেস সর্বভারতীয় স্তরে বিরোধী দলগুলির সমন্বয় সাধনে উদ্যোগী হইয়াছিল, নির্বাচনী সাফল্য স্বভাবতই তাহাতে নূতন মাত্রা ও শক্তি যোগ করে। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে এই দলের আচরণে অসঙ্গতি ও স্ববিরোধের দুর্লক্ষণ উত্তরোত্তর বাড়িতেছে। বিশেষত, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে দলনেত্রীর ক্রমাগত আক্রমণ, নিজেদের ‘আসল কংগ্রেস’ বলিয়া দাবি করা, কেন্দ্রীয় প্রশাসন তথা গোয়েন্দারা কেন কংগ্রেসের ‘মাথা’দের ছাড়িয়া রাখিয়াছে, ইত্যাকার নানাবিধ অস্ত্র শাণাইয়া তিনি সংশয় সৃষ্টি করিয়াছেন— কে তবে তাঁহার বা তাঁহার দলের প্রধান প্রতিপক্ষ, বিজেপি না কংগ্রেস?
কেবল বাক্যবাণ নহে, অন্য অস্ত্রও শাণানো হইতেছে। ত্রিপুরা নাহয় তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে রাজনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু গোয়া বা পঞ্জাবের মতো দূরবর্তী রাজ্যেও বিধানসভা নির্বাচনে এই দল প্রার্থী দিলে নিজের নাক কাটিয়া কংগ্রেসের যাত্রাভঙ্গ করিবার অভিযোগ স্বাভাবিক এবং অনিবার্য নহে কি? লক্ষণীয়, ভবানীপুর কেন্দ্রের উপনির্বাচনে কংগ্রেস মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে প্রার্থী না দিয়া জাতীয় রাজনীতির বৃহত্তর প্রয়োজনে ক্ষুদ্রস্বার্থ ত্যাগের একটি দৃষ্টান্ত রাখিয়াছে। সেই কারণেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর এই প্রবল কংগ্রেস-বিরোধিতা আরও বেশি সংশয় জাগায়। তিনি বলিতেই পারেন, এই সংশয় অমূলক, তিনি কেবল পশ্চিমবঙ্গে নহে, জাতীয় রাজনীতির ময়দানেও বিজেপির বিরোধিতায় সত্যই আন্তরিক। কিন্তু তাঁহাকে দুইখানি কথা মনে রাখিতে হইবে। এক, এই সংশয়টুকুই বিরোধী রাজনীতির পক্ষে ক্ষতিকর, কারণ তাহা জনমনে বিরোধী ঐক্য সম্পর্কে হতাশা বাড়াইবে। দুই, জাতীয় রাজনীতির ময়দানটি আপনার মহিমা প্রদর্শনের স্থান নহে, ‘কে কত বড় বিরোধী’ তাহা প্রমাণ না করিয়া সমবেত বিরোধিতার শক্তিকে জোরদার করাই সেখানে প্রকৃত লক্ষ্য। সম্ভাবনার রাজনীতি একা একা ছবি আঁকিবার শিল্প নহে।