TMC

অসভ্যতার প্রদর্শনী

গণতন্ত্রের গভীরে যাওয়া নয়, এটাই হল গণতন্ত্রের উচ্ছন্নে যাওয়ার নমুনা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০২২ ০৭:৫৬
Share:

সোমবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় যা ঘটেছে, তার দায়ভাগ নিয়ে শাসক এবং বিরোধী দলের জনপ্রতিনিধিদের তরজা চলছে, মনে হয় আরও দিনকতক চলবে। সেই পবিত্র সংসদীয় বিতর্কের মোদ্দা কথা কারও অজানা নয়— দুই তরফের যোদ্ধারাই তারস্বরে রায় দিয়েছেন: আমরা ভালো লক্ষ্মী সবাই, তোমরা ভারি বি‌শ্রী। কে ক’ভরি লক্ষ্মী আর কে-ই বা ক’ছটাক বিশ্রী, সেই অসার বচসা আপাতত থাকুক। পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকের এখন প্রশ্ন একটাই: পাঁচ বছর অন্তর অন্তর ঢাকঢোল পিটিয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা এবং বিস্তর বোমা গুলি ও অন্তত কয়েকটি তাজা প্রাণ খরচ করে বিধানসভা নির্বাচন করা আর তার পরে পাঁচ বছর ধরে থেকে থেকে সেই সভার অধিবেশন ডেকে কিছু দিন নিত্যনৈমিত্তিক শোরগোল তোলা আর মাঝে মাঝে মারামারির কুনাট্য জমানো— এই বদরসিকতার মানে কী, আর তার দরকারটাই বা কোথায়? বিধানসভায় আইন পাশ করার যে কাজ, সেটা তো এখন স্রেফ সংখ্যার জোরেই সারা হয়ে যায়, আলোচনা বা বিতর্ক নামের যে সব গালভরা কর্তব্য নিয়ে এক কালে বিধায়করা মাথা ঘামাতেন, এখন তো সে-সব কেবল স্কুলপাঠ্য ‘সিভিক্স’-এর বইতে লেখা থাকে। বিধানসভায় একটা যথার্থ বিতর্কের বিবরণ শেষ কে কবে শুনেছেন বা পড়েছেন, আজ আর মনে করতে পারবেন কি?

Advertisement

এখানে দুটো প্রতিযুক্তি উঠতে পারে। প্রথমত, কি বিধানসভা, কি লোকসভা বা (এমনকি ‘বরিষ্ঠ’) রাজ্যসভা, সর্বত্রই তো এমন ধুন্ধুমার অনেক কালই চলছে, এক যুগেরও বেশি হয়ে গেল লোকসভার তৎকালীন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় জনপ্রতিনিধিদের অশোভন আচরণ নিয়ে কেবল তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেই থেমে থাকেননি, প্রচণ্ড তিরস্কার এবং কঠোর শাস্তির ব্যবস্থাও করেছিলেন, লাভ কী হল? বলা বাহুল্য, এই যুক্তি হাল ছেড়ে দেওয়ার অজুহাত, তাই ধর্তব্য নয়। দু’নম্বর যুক্তিটা আর একটু চতুর। অনেকে বলে থাকেন, আগে সমাজের শিক্ষিত উচ্চবর্গের লোকে জনপ্রতিনিধি হতেন, আইনসভাতেও ভদ্রজনোচিত সৌজন্যের সুবাতাস বইত; এখন গণতন্ত্র সমাজের গভীরে সঞ্চারিত হয়েছে, তাই সংসদীয় আচরণের পুরনো ছকে এই যুগে বিচার করলে চলবে না। এমন সওয়াল শুনলে প্রথমটা একটু ঘোর লাগতে পারে, কিন্তু একটু আঁচড়ালেই বোঝা যায়, এ হল যুগের হাওয়ার নাম করে অসভ্যতাকে মেনে নেওয়ার কুযুক্তি। গণতন্ত্রের গভীরে যাওয়া নয়, এটাই হল গণতন্ত্রের উচ্ছন্নে যাওয়ার নমুনা।

এবং সেই কারণেই ‘যা হওয়ার তা-ই হবে’ বলে পাশ ফিরে শুলে গণতন্ত্র নিয়ে বাগাড়ম্বরের আর কোনও মানে থাকে না। রোগ বাড়তে বাড়তে চরমে পৌঁছলে অবিলম্বে চিকিৎসা জরুরি হয়ে ওঠে। রোগ যে আসলে কত ভয়ানক অবস্থায় পৌঁছেছে, সোমবারের বিধানসভায় তার রক্তাক্ত প্রমাণ মিলেছে— অন্তত এক জন বিধায়কের ক্ষেত্রে আক্ষরিক অর্থেই রক্তাক্ত; তাঁর নাক কে ভেঙেছে, অথবা কার ধাক্কায় মাটিতে পড়ে ভেঙে গেছে, সেই অসার প্রশ্ন নিয়ে বঙ্গীয় চণ্ডীমণ্ডপ ব্যস্ত হতে পারে, যে কোনও সচেতন নাগরিক শিউরে উঠে বলবেন, এই কদর্য দৃশ্য যেন আর কখনও দেখতে না হয়। সুনাগরিকের সেই সঙ্গত দাবি পূরণের দায়িত্ব অবশ্যই রাজনৈতিক নায়কনায়িকাদের, বিশেষ করে যাঁরা বিধানসভা এবং সরকার চালাচ্ছেন— তাঁদের। কেন তাঁদের দায় প্রথম এবং প্রধান, তার একটি সহজ ব্যাখ্যা আছে। দায়িত্ব ক্ষমতার উল্টো পিঠ। শোনা গেছে, মুখ্যমন্ত্রী নাকি বিধানসভার খবর শুনে উদ্বিগ্ন। শুকনো উদ্বেগের দাম কানাকড়িও নয়, সে-কথা নিশ্চয় তাঁর অজানা নয়। তাঁকেই সবার আগে এই অধঃপতন রোধ করার দায়িত্ব নিতে হবে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement