বাগনানে যাহা ঘটিল, তাহা ভয়ঙ্কর। কিন্তু, তাহাকে কোনও অর্থেই ব্যতিক্রমী বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলিবার উপায় নাই— সন্ত্রাসের পরিপ্রেক্ষিতেও নহে, তাহার প্রতিক্রিয়াতেও নহে। রাজ্যে এই বৎসর যত নির্বাচন-পরবর্তী সন্ত্রাসের অভিযোগ উঠিয়াছে, তাহা পশ্চিমবঙ্গের নিরিখেও অভূতপূর্ব। শাসকরা ক্রমাগতই অভিযোগ অস্বীকার করিয়াছেন বটে, কিন্তু জাতীয় মানবাধিকার কমিশন হইতে হাই কোর্ট, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই যেমন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সন্ত্রাসের কথা বলিয়াছে, তাহাকে উড়াইয়া দেওয়া অসম্ভব— এমনকি, রাজ্যের শাসকরা মানবাধিকার কমিশনের ন্যায় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যে রাজনৈতিক পক্ষপাতের অভিযোগ করিয়াছেন, সে কথা মাথায় রাখিলেও। বাগনানের ঘটনাটিতেও অভিযোগ, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করিতেই এক বিজেপি কর্মীর অসুস্থ স্ত্রীকে গণধর্ষণ করিল শাসক দলের কিছু কর্মী। অভিযোগটি যদি সত্য হয়, তবে এই লজ্জা ঢাকিবার কোনও উপায় পশ্চিমবঙ্গের নাই। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নারী-নির্যাতনের আকার ধারণ করিলে ধিক্কার জানাইবার ভাষা থাকে না। মুখ্যমন্ত্রীর কর্তব্য, এই ঘটনাটিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া। যে নেতা-কর্মীরা এই ন্যক্কারজনক ঘটনার সহিত এমনকি পরোক্ষ ভাবেও জড়িত, তাহাদের রেয়াত না করা। বুঝাইয়া দেওয়া যে, কোনও মতেই এমন ঘৃণ্য আচরণ বরদাস্ত করা হইবে না। হ্যাঁ, এই কাজগুলি করিতে হইলে প্রথমে ঘটনাটির দায় স্বীকার করিতে হইবে। মানিতে হইবে যে, পশ্চিমবঙ্গে এই ঘটনা ঘটিয়াছে— পশ্চিমবঙ্গে এমন ঘটনা ঘটিয়া থাকে। এই স্বীকারোক্তি বিরোধী রাজনীতির হাতে একটি মোক্ষম অস্ত্রও তুলিয়া দিবে। কিন্তু, রাজ্যকে যদি বাঁচাইতে হয়, যদি আইনের শাসন ফিরাইয়া আনিতে হয়, তবে উপায়ান্তর নাই।
মুখ্যমন্ত্রীকে স্মরণে রাখিতে হইবে যে, তিনি কেবল তৃণমূল কংগ্রেস নামক দলটির নেত্রী নহেন, তিনি পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটির প্রধান। তাঁহার নিকট দলের ঊর্ধ্বে প্রশাসনের স্থান— তাঁহাকে সমদর্শী হইতেই হইবে। যে রাজনৈতিক রঙের কর্মীর উপরই হামলা হউক না কেন, তিনি এই রাজ্যের নাগরিক, ফলে তাঁহার নিরাপত্তার ভার মুখ্যমন্ত্রীর উপরই বর্তায়। এই মুহূর্তে তাঁহার কাজ দ্বিবিধ— এক, তাঁহাকে নিজের দলের রাশ টানিতে হইবে; দুই, প্রশাসনকে নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করিবার পরিসর দিতে হইবে। দলকে তিনি কী ভাবে নিয়ন্ত্রণ করিবেন, সেই বিবেচনা একান্তই তাঁহার। তবে, বিরোধীদের প্রতি হিংসাত্মক আচরণ করিলে যদি অভিযুক্তকে দলীয় পদ হইতে বহিষ্কার করা হয়, যদি দলের অভ্যন্তরে শাস্তির ব্যবস্থা হয়, তবে অনেকেরই আচরণ সংযত হইবে বলিয়া আশা করা যায়।
প্রশাসনকে নিরপেক্ষ থাকিতে দিবার কাজটি তুলনায় সহজ। মুখ্যমন্ত্রী বলিয়া দিতে পারেন যে, তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রশাসনের কাজে হস্তক্ষেপ করিবেন না; অন্য কাহারও হস্তক্ষেপ বরদাস্তও করিবেন না। কাহারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করিবার সময় পুলিশকে রাজনৈতিক রং বাছিতে হইবে না। অন্য দিকে, পুলিশকেও নিজের কর্তব্যের কথা স্মরণে রাখিতে হইবে। বাগনানে পুলিশের বিরুদ্ধে তথ্যগোপন, নির্যাতিতার উপর চাপ সৃষ্টি ইত্যাদি অভিযোগ উঠিয়াছে— যেমন অভিযোগ রাজ্যে উঠিয়াই থাকে। অভিযোগ যদি অংশতও সত্য হয়, তাহা ভয়ঙ্কর। অপরাধীকে রক্ষা করা কোনও অবস্থাতেই পুলিশের কাজ হইতে পারে না। অস্বীকার করিবার উপায় নাই যে, পুলিশবাহিনীর মধ্যে সেই বাম আমল হইতে রাজনৈতিক আনুগত্য বজায় রাখিবার যে অভ্যাস গড়িয়া উঠিয়াছে, সহসা তাহাকে ঝাড়িয়া ফেলা মুশকিল। তবু দাবি রহিল— পুলিশ কর্তারা নিজেরাও স্মরণে রাখুন, অধস্তন কর্মীদেরও স্মরণ করাইয়া দিন যে, পুলিশের দায়বদ্ধতা সংবিধানের প্রতি, সাধারণ মানুষের প্রতি— শাসকের প্রতি নহে।