ঘটনার ভয়াবহতা যখন মানুষকে নাড়াইয়া দেয়, তখন হয়তো সে প্রেক্ষাপটটিও ভুলিতে বসে। অসমের দরং উপত্যকার বর্বরোচিত ঘটনাটির বিহ্বলতা কাটাইয়া উহার পশ্চাৎপটে নজর রাখিলে বোঝা যাইবে, তাহাও কিছু কম ভয়ানক নহে। এক অধিকাররক্ষা দলের তদন্ত-রিপোর্ট বলিতেছে যে, গত জুলাই মাসে ‘মুসলমান-অধ্যুষিত জেলাগুলিতে জন্মহার নিয়ন্ত্রণে’ সরকার কর্তৃক ‘জনসংখ্যা সেনা’ তৈরির কথা জানান অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা; অতঃপর উগ্র অসমিয়া জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীবর্গ ‘জবরদখলকারী’দের নিশ্চিন্ততার বিপরীতে ‘স্থানীয়’দের দুর্দশার কাহিনি শুনাইয়া পরিস্থিতি উত্তপ্ত করিয়া তোলে; বাসিন্দারা আদালতে গেলে মামলা নিষ্পত্তির আগেই ‘বসতি স্থাপনকারী’দের উচ্ছেদকার্যে নামিয়া পড়ে হিমন্তের সরকার। ঘটনাক্রমই সম্ভবত এই সামাজিক অস্থিরতার রকমফের প্রমাণ করিয়া দিবে। ইহা কেবল দলীয় রাজনীতির খেলা নহে, এক ক্রূরমতি প্রশাসনের সুচিন্তিত চাল। রাজনৈতিক উস্কানি বা মদতের ফলে সামাজিক সংঘর্ষ ভারতে নূতন নহে, বহু যুগ ধরিয়া বহু রাজ্যেই তাহা ঘটিতেছে, ভোট-পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গের নামও তাহাতে উঠিয়াছে। কিন্তু, হিংসার আড়ালে প্রশাসনের সব স্তরের সক্রিয় অংশগ্রহণ অসমের ঘটনাটিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়াছে।
ইহা ব্যতিক্রম, অতএব উদ্বেগজনক। প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের আচরণ অপরাধীদের প্রবৃত্ত করিতেছে, অপরাধ করিবার ব্যবস্থাটি সাজাইয়া দিতেছে, কেহ ধরা পড়িলে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করিতেছে না, এমনকি তাহার প্রতি সমর্থনও লুকাইয়া রাখিতেছে না— এই সকল বার্তা উদারমনস্ক গণতন্ত্রের পক্ষে সুসংবাদ নহে। প্রশাসনের মতাদর্শ যদি দুষ্কৃতীদের সমর্থন জোগায়, ক্ষেত্রবিশেষে রক্ষা করে, উহাপেক্ষা দুর্ভাগ্যের কিছু হয় না। অসম সরকার বাস্তবিকই দরং-এর বাসিন্দাদের ক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টা করে নাই, বরং ‘অনুপ্রবেশকারী’দের সরাইয়া ‘স্থানীয়’দের জায়গা করিয়া দিবার তত্ত্বটি তুলিয়া ধরিয়াছে। দুই জনের মৃত্যুর পরেও কোনও সরকারি প্রতিনিধি নিহতের পার্শ্বে দাঁড়াইবার প্রয়োজন বোধ করেন নাই।
বিজেপি-শাসিত উত্তরপ্রদেশের কথা স্মরণে আসে। অসমের মুখ্যমন্ত্রী যখন বন্দুকনলের ক্ষমতাকেই ‘স্বাভাবিক নিয়ম’ বলেন, তখন গত চার বৎসরে উত্তরপ্রদেশ পুলিশের নিয়মিত শুটআউটের (পোশাকি নাম ‘এনকাউন্টার’) ঘটনাবলি, এবং বিচার-বহির্ভূত হত্যাকে সুবিচার দানের প্রক্রিয়া বানাইয়া তোলা— সকলই মনে করিতে হয়। আদিত্যনাথের সরকার যেমন গো-জবাইয়ের ঘটনায় জাতীয় নিরাপত্তা আইনে মামলা করিয়াছে, অথবা সিএএ-এনআরসি বিরোধী প্রতিবাদীদের নামের তালিকা দেওয়ালে সাঁটিয়াছে, হিমন্তও তেমনই ‘৬৫ শতাংশ বনাম ৩৫ শতাংশ’ কিংবা ‘মিয়া মুসলিম’ আসলে ‘বেআইনি’, ‘উইপোকা’, ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ প্রভৃতি ঘৃণামূলক প্রচারকে ভোট হইতে প্রশাসনে টানিয়া লইয়াছেন। মেরুকরণের যে বাগাড়ম্বরে তাঁহাদের রাজনীতিতে হিংস্রতার জন্ম, তাহা প্রশাসন অবধি পৌঁছাইবার ফল এই অবশ্যম্ভাবী হিংসা। সরকারি তকমায় এই ভাবেই বেকানুন হইয়াছেন উত্তরপ্রদেশ, অসমের মুসলমানেরা। এবং, আদিত্যনাথের পর হিমন্ত— রাজ্যে-রাজ্যে অবতারের জন্ম গোটা দেশের পক্ষেও আশঙ্কার বইকি।