—প্রতীকী ছবি।
সমষ্টির স্বার্থ ও ব্যক্তিস্বাধীনতা, দুইয়ের মধ্যে সম্পর্কটি টানাপড়েনের। সংবিধান ভারতের প্রত্যেক নাগরিককে মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছে, রাষ্ট্রকে বলেছে সর্বাবস্থায় তা রক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে। আবার ব্যক্তির আচরণ বা কাজ যাতে সমষ্টির স্বার্থের পরিপন্থী না হয়, সহনাগরিকের ক্ষতি না করে, সে দায়িত্বের কথাও মনে করিয়ে দিয়েছে। দুইয়ের ভারসাম্য রক্ষার কাজটি নাগরিকের নিঃসন্দেহে, কিন্তু আরও বেশি করে তা রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র-পোষিত ‘এজেন্সি’গুলির— তাদের হাতে থাকা বিপুল ক্ষমতার কারণেই তাদের দায়বদ্ধতাও বেশি। ব্যক্তি ও সমষ্টির দ্বৈরথ সব সময়েই ছিল, কিন্তু আজকের ভারতে একটি প্রবণতা ক্রমবর্ধমান— ক্ষমতার জোরে সমষ্টি শ্বাসরোধ করছে ব্যক্তিস্বাধীনতার। তার চরম উদাহরণটি দেখা গেল মুম্বইয়ে, এক নামী স্কুলের অধ্যক্ষাকে স্কুল পরিচালন কর্তৃপক্ষ বরখাস্ত করলেন— সমাজমাধ্যমে প্যালেস্টাইনের সমর্থনে লেখা বেশ কিছু পোস্টে তিনি ‘লাইক’ দিয়েছেন বলে! স্কুল কর্তৃপক্ষের যুক্তি, অধ্যক্ষার এই কাজে স্কুলের একতা, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে পথ চলার যে মূল্যবোধ তা লঙ্ঘিত হয়েছে। তাই এই সিদ্ধান্ত।
সংশয় জাগে, এই ভারতে কি তা হলে ব্যক্তিসত্তার বাধ্যতামূলক দমন-অবদমনই ভবিতব্য? শিক্ষক বলে কি এক জন মানুষ নিজের ব্যক্তিগত বোধ ও বিশ্বাসকে সমাজমাধ্যমেও কোনও অবস্থায় প্রকাশ করতে পারবেন না? ভারতীয় সমাজে শিক্ষকদের জন্য শ্রদ্ধা-সম্মানের আসন পাতা, কিন্তু দেখা যাচ্ছে— শিক্ষক সত্তার আড়ালের ব্যক্তি মানুষটি প্রকাশিত হয়ে পড়লে সেই শ্রদ্ধার আসন টলে যাচ্ছে, তার জায়গা নিচ্ছে অস্বস্তি, নিরাপত্তাহীনতা, বিরক্তি, ক্রোধ। এই সব কিছুর দায় নিতে হচ্ছে ব্যক্তি মানুষটিকে: তাঁর উপর নেমে আসছে হিংসা ও বিষোদ্গার, মূল্য চোকাতে হচ্ছে কর্মচ্যুত হয়ে। মুম্বইয়ের ওই শিক্ষিকা বারো বছর ওই স্কুলের সঙ্গে যুক্ত, অধ্যক্ষা পদে গত সাত বছর স্কুলকে নিয়ে গেছেন ঈর্ষণীয় উচ্চতায়— এই সবই অসার হয়ে দাঁড়াল সমাজমাধ্যমে স্রেফ কয়েকটি প্রতিক্রিয়ার পাশে। এমন নয় যে তিনি প্যালেস্টাইনের সমর্থনে বিতর্কিত, স্পর্শকাতর বা ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিভ্রান্তিকর কিছু লিখেছেন— লিখলেও তা ব্যক্তির মত প্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার দ্বারা সর্বাবস্থায় স্বীকৃত। কিন্তু কে কী ‘লাইক’ বা ‘শেয়ার’ করবেন, তারও একপেশে বিচার হবে সমষ্টির কাঠগড়ায়?
এখানেই আশঙ্কা হয়, সর্ষের ভিতরে আছে অন্য বিদ্বেষের ভূত। আজকের ভারতে ধর্মপরিচয় মোক্ষম বিভেদাস্ত্র, বিশেষত শাসক ও তাঁর অনুগামী ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠের হাতে। তার জোরে যে কোনও ব্যক্তিস্বরকেই দমিয়ে বা চুপ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তিনি শিক্ষক সাংবাদিক সমাজকর্মী বা বিরোধী দলনেতা যে-ই হোন না কেন। মুম্বইয়ের শিক্ষিকা অভিযোগ করেছেন তিনি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রাজনীতির শিকার। এই অভিযোগ অমূলক নয়। ব্যক্তির ধর্মপরিচয় বা ধর্মনিরপেক্ষতা, দুই-ই আজকের ভারতে আক্রান্ত, তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে ধর্মের রঙে রাঙিয়ে নিজ স্বার্থসিদ্ধিই এই বিভেদপন্থী রাজনীতির কাজ। এখানেও অধ্যক্ষার ধর্মীয় সংখ্যালঘু পরিচয়কে সমাজ, এমনকি তাঁর স্কুলও জুড়ে নিয়েছে তাঁর সমাজমাধ্যম-প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে। ঘরে গোমাংস রাখার মনগড়া অভিযোগে এ দেশে মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলা যায়, ভিনধর্মী দিদিমণিকে বরখাস্তের চিঠি ধরানো তো জলভাত।