Unbiased Media

অপরিহার্য

শাসকের সুরে সুর না মেলালে সাংবাদিক বা সংবাদমাধ্যমের কী হয়, কী হতে পারে, তার উদাহরণ এখন না খুঁজলেই মেলে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০২৩ ০৭:১৩
Share:

—প্রতীকী চিত্র।

নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যম শাসকের চোখের বালি। বিশেষত, সেই শাসকের যিনি নাগরিক স্বাধীনতা অর্থাৎ গণতান্ত্রিকতার তোয়াক্কা করেন না। ‘রাজা, তোর কাপড় কোথায়’— জনসমক্ষে এ কথাটি বারংবার জিজ্ঞাসা করে চলাই নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যমের কাজ। প্রশ্নটি দমনপ্রিয় ‘রাজা’র পক্ষে অস্বস্তিকর, ফলে যে সংবাদমাধ্যম দাঁড়ের টিয়াপাখি হতে অসম্মত হয়, তার কণ্ঠরোধ করার তাড়না প্রকট হয়ে ওঠে। তার এক দিকে রয়েছে পুলিশ বা তদন্তকারী সংস্থাকে ব্যবহার করে সাংবাদিকদের হেনস্থা করা; অন্য দিকে রয়েছে সংবিধানের পাশ কাটিয়ে সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধের চেষ্টা। সম্প্রতি কলকাতা হাই কোর্টে একটি মামলা উঠেছিল, যার বক্তব্য— সংবাদমাধ্যম ‘অতিরঞ্জিত’ সংবাদ প্রকাশ করে বাদী পক্ষের সম্মানহানি করছে। সেই প্রসঙ্গে বিচারপতি সব্যসাচী ভট্টাচার্য প্রশ্ন করলেন, সংবাদমাধ্যমের খবর প্রকাশনার উপরে কী ভাবে এমন হস্তক্ষেপ করা যেতে পারে? তিনি মনে করিয়ে দিলেন যে, ভারতীয় সংবিধান সংবাদমাধ্যমকে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসাবে স্বীকার করে। এই দুঃসময়ে বিচারপতি ভট্টাচার্যের পর্যবেক্ষণটি অতি মূল্যবান। কেন, তা গত কয়েক মাসের কথা স্মরণ করলেই বোঝা যাবে। সংবাদমাধ্যম কোন তথ্য প্রকাশ করতে পারে আর কোনটা পারে না, সংবাদের সূত্র প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক কি না, সরকারের কোন মহল থেকে দেওয়া তথ্যকেই সংবাদ হিসাবে বিবেচনা করতে হবে— এমন হরেক প্রশ্ন গত কয়েক মাসে উঠেছে। প্রশ্নগুলির ধরনেই স্পষ্ট যে, সেগুলির উদ্দেশ্য যে কোনও ভাবে শাসকের পক্ষে অস্বস্তিকর প্রশ্নগুলিকে গণমাধ্যমের চৌহদ্দির বাইরে রাখা। কলকাতা হাই কোর্টের পর্যবেক্ষণটি এই জন্যই সাংবাদিক থেকে সাধারণ মানুষ, সকলের কাছে এই দুঃসময়ে আশার বাহক।

Advertisement

শাসকের সুরে সুর না মেলালে সাংবাদিক বা সংবাদমাধ্যমের কী হয়, কী হতে পারে, তার উদাহরণ এখন না খুঁজলেই মেলে। পুলিশের ধরপাকড়, অথবা বিশেষ তদন্তকারী সংস্থার চাপিয়ে দেওয়া ইউএপিএ-র অধীনে মামলার বাইরেও হেনস্থার অন্য কিছু রূপ আছে। তার মধ্যে একটি পরিচিত পন্থা হল সরাসরি সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে মানহানি বা অন্য কোনও মামলা রুজু করা। যাঁর বিরুদ্ধে মামলা, তিনি বছরভর এক আদালত থেকে অন্য আদালতে দৌড়ে বেড়াতে বাধ্য হন। বহু ক্ষেত্রেই সেই মামলা শেষ অবধি খারিজ হয়ে যায়, অভিযুক্ত বেকসুর খালাস পান। কিন্তু মামলার প্রক্রিয়াটিই যথেষ্ট শাস্তি হয়ে দাঁড়ায়— বিনা অপরাধে, বিনা বিচারে শাস্তি। কলকাতা হাই কোর্টের পর্যবেক্ষণ দেখে নাগরিকের মনে হয়তো ক্ষীণ আশা জন্মাবে যে, শাসকের এই কৌশল এ বার প্রতিহত করার পথ বেরোবে। সাংবাদিক বা সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে অহেতুক মামলা দায়ের করার এই প্রবণতাটি রুখতে আদালত কঠোর পদক্ষেপ করবে।

রাজনৈতিক মহল থেকে বারে বারেই অভিযোগ ওঠে যে, সংবাদমাধ্যম নিজস্ব বিচারসভা বসায়— যাকে বলা হয়ে থাকে ‘ট্রায়াল বাই মিডিয়া’। সংবাদমাধ্যম কখনও তার অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করে না, তেমন দাবি করা অনুচিত হবে। কিন্তু, এ কথাও অনস্বীকার্য যে, যাঁরা মিডিয়ায় বিচারসভা বসাতে অভ্যস্ত, শাসকরা বহু ক্ষেত্রেই তাঁদের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হন না— কারণ, তাঁরা শাসকের পক্ষেই তারস্বরে চিৎকার করেন। মিডিয়ার বিচারসভা যে পক্ষেই রায় দিক না কেন, তাকে যে গণতান্ত্রিক সীমার মধ্যেই রাখতে হবে, তা নিয়ে সংশয় নেই। কিন্তু, সংবাদমাধ্যম কী বলবে, তা নির্ধারণ করে দেওয়ার কাজটি যে শাসনবিভাগের নয়, কলকাতা হাই কোর্ট তা জানিয়ে দিল। নাগরিকের কাছে তথ্য এবং মতামত পৌঁছে দেওয়ার কাজটি গণতন্ত্রের সুস্বাস্থ্যের পক্ষে অপরিহার্য। সংবাদমাধ্যম যাতে সেই কাজটি করতে পারে, তা নিশ্চিত করার জন্য বিচারবিভাগের এই বিবেচনার মুখাপেক্ষী থাকা ভিন্ন উপায়ান্তর নেই।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement