—প্রতীকী চিত্র।
ঘর বলতে শুধুমাত্র মাথার উপর ছাদটুকুই বোঝায় না। পরিবার-সান্নিধ্যে তা এক পরম স্বস্তির পরিবেশও গড়ে তোলে। কিন্তু সব ক্ষেত্রে নয়। বিশেষত, ভারতের মতো পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় প্রায়শই মেয়েদের উপর নির্যাতনের প্রথম আঘাতটি নেমে আসে নিজের ঘর থেকেই, অতিঘনিষ্ঠ জনের কাছ থেকেই। সম্প্রতি উন্নাওয়ের নির্যাতিতা যেমন থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে। সেই উন্নাও ধর্ষণ মামলা, ২০১৭ সালে যা সংবাদ শিরোনামে উঠে আসে। নির্যাতিতা মেয়েটি ধর্ষণ এবং তাঁর বাবাকে খুন করার অভিযোগ তুলেছিলেন উন্নাওয়ের তৎকালীন বিজেপি বিধায়ক কুলদীপ সেঙ্গারের বিরুদ্ধে। অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় কুলদীপের। সেই প্রতিবাদিনী এখন ফের থানার দ্বারস্থ। অভিযোগ, তাঁর নামে বরাদ্দ অর্থের এক বড় অংশ আত্মসাৎ করেছেন তাঁর কাকা। মেয়েটির মা ও বোন সেই চক্রান্তেরই অংশ বলেও অভিযোগ। দিল্লিতে তাঁকে যে বাড়ি দেওয়া হয়েছিল, সেই বাড়ি থেকে তাঁর ঘনিষ্ঠ জনেরা তাঁকে বার করে দিয়েছেন। অত্যাচার, অসম্মান, আইনি লড়াইয়ের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে তিনি যখন নিজ সংসার-জীবনে থিতু হওয়ার মুখে, অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ সুরক্ষায় ব্যগ্র, ঠিক তখনই ফের ঝড় উঠেছে তাঁর জীবনে। ঝড়ের উৎস এ বার তাঁর নিজ ঘর-পরিবারই।
ভারতের ক্ষেত্রে এই চিত্র ব্যতিক্রম নয়। যে সমাজে এক বৃহৎ সংখ্যক অভিভাবক তাঁদের কন্যাসন্তানকে বড় করে তোলেন এই শিক্ষায় যে, স্বামী অত্যাচার করলেও তা মানিয়ে নেওয়াই সংসার জীবনের পবিত্র ধর্ম, পরিবারের ঘনিষ্ঠ কেউ শিশুকালে অশালীন ভাবে স্পর্শ করলেও সেই কথা চেপে যেতে হয়, সেই সমাজে মেয়েদের বিপন্নতা কমার নয়। ধর্ষণের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে সেই বিপন্নতা আরও তীব্র ভাবে ধরা পড়ে। বহু উদাহরণ পাওয়া যায়, যেখানে ধর্ষিত মেয়েটিকে নিজ পরিবারই গ্রহণ করতে চায়নি, অথবা দূরে পাঠিয়ে দিয়েছে পরিবারের সম্মানহানির কথা ভেবে। সুতরাং, এক নির্যাতিতার কাছে যে পরিবারই একমাত্র ভরসাস্থল নয়, সেই কথাটি অস্বীকারের উপায় নেই। তদুপরি, নির্যাতিতা নাবালিকা হলে তার বিপন্নতা আরও বাড়ে। সরকারি ক্ষতিপূরণের অর্থ তার নামে বরাদ্দ হলে অভিভাবকত্বের অজুহাতে তা আত্মসাৎ করা, এবং মেয়েটিকে বঞ্চিত করার পথটিও খুলে যায়।
সরকার যে এই বিপদের সম্ভাব্য উৎসগুলি জানে না, তা নয়। তা সত্ত্বেও অঘটন ঘটলে কিছু অর্থ বরাদ্দ, একটি বাসস্থান, বা চাকরির ব্যবস্থা করেই দায় ঝেড়ে ফেলার প্রবণতাটি তার ঘোচে না। এই ক্ষেত্রে একান্ত প্রয়োজন, এক জন আক্রান্ত, নির্যাতিত মেয়ে পরিবারের সাহায্য পাবে না এমনটা ধরে নিয়ে সরকারের তরফ থেকেই এমন একটি সুসংহত, পরিকল্পিত ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেখানে মেয়েটিকে মানসিক, চিকিৎসা সংক্রান্ত বা আইনি সাহায্য করার জন্য সর্বদা উপযুক্ত সংখ্যক কর্মী মজুত থাকবে। সরকারি নজরদারিতে অ-সরকারি সংস্থাগুলির হাতেও সেই দায়িত্ব তুলে দেওয়া যায়। ক্ষতিপূরণ নির্যাতিতার সাময়িক সুরাহা করতে পারে। কিন্তু শরীর, মনের গভীর ক্ষত পূরণ করে, পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে লড়াই করতে পারে না। এই কাজে যদি পরিবার মেয়েটির পাশে না দাঁড়ায়, জনকল্যাণের কথা ভেবে সরকারেরই এগিয়ে আসা আবশ্যক।