— ফাইল চিত্র।
আপেক্ষিকতা তত্ত্ব যদি কঠিন ঠেকে, পশ্চিমবঙ্গের পুলিশের দ্বারস্থ হওয়া যায়। ১৪৪ ধারার উদাহরণ দিয়ে জলের মতো বুঝিয়ে দেওয়া যাবে যে, সবই আপেক্ষিক। যেমন, সন্দেশখালিতে ১৪৪ ধারা জারি করে বিরোধী নেতাদের নদীর ও-পাড় থেকেই বিদায় করে দেওয়া যায়, কিন্তু তার থেকে একশো কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে বিধাননগরের নয়াপট্টিতে সেই ১৪৪ ধারা ভেঙেই সমাজবিরোধীরা তাণ্ডব করলেও পুলিশ স্পিকটি নট। আবার, এই বিধাননগরেই ১৪৪ ধারার জোরে চাকরিপ্রার্থী আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দিত পুলিশ। পুলিশের এ-হেন আপেক্ষিকতাবাদী অবস্থানের কারণটি অবশ্য রাজ্যবাসী বিলক্ষণ জানেন— কার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, তার উপরে পুলিশের সক্রিয়তা নির্ভর করে। বিরোধী পক্ষকে আটকাতে পুলিশ যতখানি তৎপর, শাসক দলের নেতা-সমর্থক-আশ্রিতদের প্রতি ততখানিই ক্ষমাশীল, স্নেহপ্রবণ। ফলে, নয়াপট্টিতে যাঁরা অবৈধ ভাবে জমি দখল করে ক্লাব তৈরি করেছেন, তাঁদের তাণ্ডবের পর দিনকয়েক কেটে গেলেও পুলিশকর্তা শুধু জানিয়েছেন, মামলা যখন হয়েছে, ব্যবস্থাও করা হবে। কবে, সেই অকিঞ্চিৎকর প্রশ্ন নিয়ে তিনি দৃশ্যত বিচলিত নন— মহাকালের নিরিখে দু’দশ দিন এ দিক-ও দিকে কী বা আসে যায়! অবশ্য, এ কথা বললে অন্যায় হবে যে, শুধু সাধারণ মানুষের প্রতি শাসক দলের অত্যাচারের ক্ষেত্রেই তাঁদের এমন চর্চিত দার্শনিকতা— শাসক দলের মেজো-সেজো নেতারা যখন পুলিশকে একটু ‘শাসন’ করেন, তখনও তাঁরা এমনই উদাস। অধুনা জেলবন্দি অনুব্রত মণ্ডলকে দেখে জেলার এক পুলিশকর্তা কেমন বিগলিত ভঙ্গিতে আসন ছেড়ে দিয়েছিলেন, ভাইরাল হওয়া সেই ভিডিয়োটির কথা অনেকেরই মনে পড়তে পারে।
পুলিশ কী করছে, রাজ্যবাসীর কাছে তা স্পষ্ট। তাতে কী ক্ষতি হচ্ছে, স্পষ্ট তা-ও। এ কথা তর্কাতীত যে, রাজ্যের শাসক দলের সুশাসনে মতি নেই, তারা মূলত ক্লায়েন্টেলিজ়ম-নির্ভর শাসনব্যবস্থা চালাতে চায়। কিন্তু, শাসকরা চাইলেও গোটা রাজ্যকে দলীয় একাধিপত্যের মঞ্চ করে তোলা যায় না, যদি না পুলিশ তাতে সক্রিয় ভাবে সহযোগিতা করে। বীরভূমে অনুব্রত মণ্ডল বা সন্দেশখালিতে শেখ শাহজাহানরা দাপট চালাতে পারেন, তার কারণ, তাঁদের সেই আইন-অতিরিক্ত ভূমিকায় পুলিশ নীরব বা সরব সম্মতি জানায়। বিধাননগরের নয়াপট্টি উদাহরণমাত্র— রাজ্যের প্রতিটি প্রান্তের প্রতিটি দুষ্কৃতী জানে, দলীয় দাদার ছত্রছায়ায় থাকতে পারলে পুলিশের তোয়াক্কা না করলেও চলবে, কারণ দাদার কথাই আইন। কোনও অবস্থাতেই পুলিশ সেই লক্ষ্মণরেখাটি অতিক্রম করবে না। এই নিশ্চয়তাই পশ্চিমবঙ্গকে আজকের অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে। এই রাজ্যে মানুষের নিরাপত্তা নেই, মতপ্রকাশের অধিকার খণ্ডিত, ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার প্রশ্নের মুখে। কারও জমি দখল করে ক্লাব তৈরি করা, আর কারও কৃষিজমি দখল করে তাতে নদীর নোনা জল ঢুকিয়ে তাকে মেছো ভেড়িতে পরিণত করা— এই দুইয়ের মধ্যে মাত্রার ফারাক থাকতে পারে, চরিত্রগত বিভেদ নেই। শাসক দলের লেজুড় হয়ে থাকার ব্যাধিটি পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের অনেক দিনের, তা এই আমলের রোগ নয়। কিন্তু, সেই অভ্যাস পুলিশকে এমন জায়গায় দাঁড় করিয়েছে, যেখানে পুলিশের আর কোনও গুরুত্বই নেই। শাসক দলের ধামাধরা হয়ে থাকা তো পুলিশের সাংবিধানিক দায়িত্ব নয়।