— ফাইল চিত্র।
গণতন্ত্র যে একটি কথোপকথনের মতো প্রক্রিয়া, যেখানে বিভিন্ন পক্ষের অংশগ্রহণ আবশ্যক— সম্ভবত ভারতের বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার সেই কথাটি বিস্মৃত হয়েছে। যেন মনে করা হচ্ছে, ভোট এমন একটা ব্যবস্থা যার মধ্য দিয়ে শাসকরা যা চান, তাকেই অতি সহজে বাস্তবে পরিণত করা যায়। তাই প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের অন্য ব্যক্তিদেরও ভাবটা এমন যে তাঁরাই শেষ কথা, বাকিদের কথার কোনও জায়গা নেই, বাকিদের পা রাখারও জায়গা নেই। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে আর কোনও জাতীয় নির্বাচনের আগে ভোট প্রক্রিয়াটিকে এমন ছেলেখেলার পর্যায়ে পর্যবসিত দেখা যায়নি। শাসকরাই আবার শাসনের দায়িত্বে ফিরবেন কি না, সেটা নাগরিকরাই ঠিক করবেন, তাই শাসকদের দিক থেকে কিছু বিনয় ও মর্যাদা প্রদর্শন প্রত্যাশিত ছিল। এ দিকে ইতিমধ্যে নির্ধারিত ভারতের অষ্টাদশ সাধারণ নির্বাচনকে বয়কট করার সিদ্ধান্ত জানালেন মণিপুরের কুকি মহিলারা। যোগ দিয়েছে বেশ কিছু যুব সংগঠনও। ৩ মে, ২০২৩ থেকে মণিপুরের জাতিহিংসার প্লাবন চলছে, খুন-ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগে বিপর্যস্ত অগণিত কুকি ঘর ছেড়েছেন, অন্যান্য রাজ্যে বাস করছেন। স্বাধীন ভারতে গণহিংসার অন্যতম ভয়ঙ্কর দৃষ্টান্ত মণিপুর— হিংসার প্রাবল্যে, মেয়াদের দৈর্ঘ্যের নিরিখেও। ন্যায় ও সুরক্ষা চেয়ে কুকি-জ়ো জনজাতিদের সব আবেদন উপেক্ষা করেছে বিজেপি-পরিচালিত রাজ্য সরকার। গোটা জনজাতির উপরে নিয়ত বর্ষিত হচ্ছে অবমাননা— মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহ কুকিদের প্রতি যে ভাষা প্রয়োগ করেছেন, তা সভ্যতা-বিগর্হিত, গণতান্ত্রিক দায়িত্ববোধ তো দূরস্থান। এই চরম অন্যায়ের প্রেক্ষিতে সংসদে, বিধানসভায়, নির্বাচনী প্রচারে, সংবাদমাধ্যমে, কতটুকু উঠে এসেছে মণিপুরের জাতিহিংসা প্রতিরোধে কেন্দ্র ও রাজ্যের ব্যর্থতার আলোচনা?
উত্তর-পূর্ব ভারতে পাহাড়বাসী জনজাতিগুলির উপরে সুপরিকল্পিত আক্রমণে, হিংসার স্রোত অপ্রতিহত রাখায়, কুকিদের বাস্তুচ্যুত করার পিছনে যে রাজ্যের নির্বাচিত সরকারের মদত রয়েছে, তা ইতিমধ্যেই যথেষ্ট স্পষ্ট। কুকি-জ়ো অধ্যুষিত দু’শোটিরও বেশি গ্রাম বিনষ্ট হয়েছে, সাত হাজারেরও বেশি বাড়ি ধ্বংস হয়েছে, সাড়ে তিনশোরও বেশি গির্জায় অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর হয়েছে। দেড়শোর বেশি মানুষ খুন হয়েছেন, বহু মেয়েকে প্রকাশ্যে ধর্ষণ, বিবস্ত্র করে ঘোরানোর ঘটনা ঘটেছে। কোনও কেন্দ্রীয় সংস্থা বিপর্যয়ের তদন্ত করেনি, অপরাধীদের গ্রেফতার করেনি।
ভারতীয় প্রজাতন্ত্রে সংখ্যালঘু মানুষ, তথা শাসক-বিরোধী জনগোষ্ঠীর মর্যাদা ও নিরাপত্তা কত বিপন্ন, তা দেখিয়েছে মণিপুর। কুকি-জ়ো’দের পত্রিকায় বলা হয়েছে, ভোট বয়কট করার মাধ্যমে তাঁরা দেখাতে চান যে কুকি-জ়ো সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব এখন শূন্য। মণিপুর কাণ্ডে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি আহত হয়েছে জনপ্রতিনিধিত্বের ধারণাটিই। দলীয় রাজনীতির প্রতিযোগিতাই নির্বাচন, কিন্তু নির্বাচিত প্রতিনিধি সব ভোটদাতা, সব জনগোষ্ঠীরই মুখপাত্র। তাঁদের দ্বারা গঠিত সরকার সব নাগরিকের অধিকারের সুরক্ষায় দায়বদ্ধ। গণতন্ত্রের এই মৌলিক নিয়ম সাড়ে সাত দশকে আত্মস্থ হওয়ারই কথা ছিল, কিন্তু তা হয়নি। ভারতে বার বার সংখ্যালঘু গোষ্ঠী, শাসক-বিরোধী জনগোষ্ঠী আক্রান্ত হয়েছে রাষ্ট্রশক্তির দ্বারা। প্রতিনিধিত্বের সঙ্কট এমনই পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে যে, নির্বাচন প্রক্রিয়া কেবল অর্থহীন নয়, অসম্ভব হতে বসেছে। কুকিরা জানিয়েছেন যে, নির্বাচনে অংশগ্রহণে তাঁরা কার্যত অপারগ। নিজেদের স্বল্প সংখ্যার জন্য কোনও কুকি প্রার্থী কোনও সাংসদ পদ পাবেন না। বড় দলগুলি যে কোনও কুকি-জ়ো ব্যক্তিকে প্রার্থী মনোনীত করবে, সে সম্ভাবনা নেই। রাষ্ট্রপোষিত হিংসার ফলে সংখ্যালঘু মানুষদের ভোটাধিকার, তথা ভোটে অংশগ্রহণের অধিকার এ ভাবেই বিপন্ন হয়। বয়কটের ডাক গণতন্ত্রের সেই সঙ্কটের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণের প্রয়াস।