Kolkata Book fair

বৈভব

সমারোহের অপর পিঠেই কলঙ্ক। কলকাতা বইমেলার সম্পর্কে সবচেয়ে বড় নিন্দার কথা শোনা যায় যে, এখানে বেশির ভাগ মানুষই বই ছাড়া অন্যান্য আকর্ষণে আসেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৪:৩১
Share:

কলকাতা বইমেলা। ফাইল চিত্র।

অলক্ষ্যে তৈরি হচ্ছে আরও এক গৌরবের মুহূর্ত। আর মাত্র গোটা দুয়েক বার্ষিক পরিক্রমণ, তার পরই কলকাতা বইমেলা পা দেবে পঞ্চাশে। ১৯৭৬ সালের শীতকালে কলকাতা পুস্তকমেলা শুরুর ইতিহাস ও ভূগোল এত দিনে অনেক আলোচিত, যদিও এখনও কিছুতে ধরা যায় না কী ছিল সেই প্রথম আয়োজনের আশ্চর্য রাসায়নিক ফর্মুলা, যা ঘটামাত্র বাঙালি জীবনে এতখানি বড় হৃদয়াবকাশ তৈরি করে দিয়েছিল সে দিন। প্রথম বছর খুব বেশি সংখ্যক বইয়ের স্টল ছিল না, বড়জোর পঞ্চাশ-ষাটটা, কলেজ স্ট্রিট তখনও হিসাব গুনছে অতটা দক্ষিণগামী হয়ে তার লাভ না ক্ষতি। তবু বাঁশের কাঠামোয় কাপড় সাঁটা, ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকা নতুন-পুরনো বই, কিংবা ঘাসের উপর গোল হয়ে বসে কবিতার সঙ্গে চা— নিশ্চয় অত্যাশ্চর্য সব গন্ধ তৈরি হয়ে উঠেছিল সেই বারের মেলায়। বাঙালির প্রাণের গন্ধ। আর তাই, শীতের কলকাতার সার্কাস, ম্যাজিক, মেলা ইত্যাদি হাজার হুজুগের পাশে আর এক বাৎসরিক উৎসব হয়ে বাঙালির ক্যালেন্ডারে ঢুকে গিয়েছিল বইমেলা। এ যেন বিজ্ঞ হতে ভালবাসা, প্রাজ্ঞ হওয়ার স্বপ্ন দেখা বাঙালি জাতির নিয়তিলেখা। দ্বিতীয় বছরেই মেলার দৈর্ঘ্য বেড়ে গেল অনেকখানি, রবীন্দ্রসদন-তারামণ্ডল অঞ্চল পুরোটাই লেগে গেল তার জন্য। বছরের পর বছর মেলার বয়স যত বাড়ল, তত বাড়ল তার চাকচিক্য, ভিড়ের জৌলুস, ঐতিহ্যের উদ্‌যাপন, তারুণ্যের প্রবাহ। ক্রমে শহরের পশ্চিম থেকে পুবে সরে বিধাননগরে যে মেলা দাঁড়াল, তার আকার ও প্রকার দুই-ই অবশ্যদ্রষ্টব্য বললে ভুল হবে না।

Advertisement

সমারোহের অপর পিঠেই কলঙ্ক। কলকাতা বইমেলার সম্পর্কে সবচেয়ে বড় নিন্দার কথা শোনা যায় যে, এখানে বেশির ভাগ মানুষই বই ছাড়া অন্যান্য আকর্ষণে আসেন। বই দেখা বই কেনার বদলে মেলার খাওয়া, মেলার ঘোরা, মেলার মজা, মেলার আড্ডা, মেলার সেলফি ইত্যাদি। প্রতি বছর নতুন গাম্ভীর্যে ধ্বনিত হয় এই নিন্দাবাক্য। এখানে দু’টি কথা না বললেই নয়। প্রথমত, আড্ডা, খাওয়া, ঘোরার জন্য অন্যতর উপলক্ষ তৈরি করাই যেত, যেমন করে থাকে অন্যান্য জনপদ, এমনকি কলকাতাও, অন্যান্য সময়ে। বই সাজিয়ে তার চার দিকেই কেন বা করতে হল এত আয়োজন? করতে হল, কেননা বই দিয়ে যে পরিবেশ তৈরি হয়, এমনকি মেলাগত মেলামেশার জন্যও বাঙালি সেই পরিবেশ পছন্দ করে— সে কি কম কথা! তদুপরি, এই মেলাগামী ভিড় কিন্তু কেবল সমাজের বিদ্যাবুদ্ধির উচ্চকোটিতে সীমাবদ্ধ নয়। তত সিরিয়াস পাঠক বলে নিজেদের মনে করেন না যাঁরা, কিংবা ছাত্রছাত্রী অল্পবয়সিরা, সকলেই উষ্ণ উৎসাহে প্রতি বছর মেলার জন্য অপেক্ষমাণ। দ্বিতীয়ত, এই কথাটি এখন প্রতিষ্ঠিত যে, বইমেলায় কিন্তু যথেষ্ট বই বিক্রি হয়। সেই বই কোন স্বাদের, কোন মানের ইত্যাদি পরবর্তী বিবেচ্য। কিন্তু যাঁরা মেলায় ঢোকেন, তাঁদের অর্ধেকের হাতেও যদি বেরিয়ে আসার সময়ে থাকে একটিমাত্র বই, তা হলে বলতে হবে একুশ শতকের অসুস্থ সময়ের নিরাময়ের জন্য এই মেলার চেয়ে উত্তম কিছু ভাবাই যায় না।

কলকাতা বইমেলাই এখনও সেই জায়গা যেখানে বড় প্রকাশনার সঙ্গে টক্কর মিলিয়ে জায়গা করে নেয় লিটল ম্যাগাজ়িনের চত্বর। যেখানে এখনও মোড় ঘুরলেই শোনা যায় পথচলতি গানের আসর। যেখানে কবি-লেখককে ঘিরে জমা হয় অসংখ্য উৎসুক পাঠকমুখ। যেখানে বড় প্রকাশকের দোকানে ঢুকতে বিরাট লম্বা লাইন, আবার তার পাশেই অখ্যাত লেখকদের বই আনমনে শায়িত দেখে তাদের হাতে তুলে নেন সন্ধানী পাঠক। যেখানে প্রয়াত কবির নামে মঞ্চ সাজিয়ে তরুণ কবি-লেখকদের সাদরে জায়গা করে দেওয়া হয় বই নিয়ে কথা বলতে। কেউ বলতে পারেন, এত কথা কেন। প্রশ্নটি যথার্থ, দেখনদারি যে সমাজমাধ্যম অধ্যুষিত একুশ শতকে বিশেষ পীড়াদায়ক পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা নিয়ে সন্দেহ চলে না। তবে দেখনদারিটাও হচ্ছে শেষ পর্যন্ত বই নিয়ে, কথাও যখন বই নিয়ে, তখন ক্ষমোষ্ণ হৃদয় বলে, থাক, হলই বা কিছু কথা এই আকালে। পাঁচ দশক পুরোবার আগে একটি কথা মেনে নেওয়াই ভাল। এক কালে বইমেলার মতো জমায়েতের সাফল্যের কারণ ছিল কলকাতার প্রতিস্পর্ধার প্রাণ, শিল্পসাহিত্যবোধের ঔদ্ধত্য। আজ যদি সে সব নেপথ্যে মিলিয়ে যায়, তবুও পড়ে থাকে সৃষ্টিসুখের উচ্ছ্বাস, অন্তত মিলনসুখের অবকাশ— বই নিয়ে না হোক, বই সাজিয়েই হোক তবে, চলুক তবে মেলা আয়োজন।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement