ইজ়রায়েলি চিত্রপরিচালক নাদাভ লাপিদ কাশ্মীর ফাইলস ছবিটি সমালোচনা করার পরই ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছিলেন বিবেক অগ্নিহোত্রী। ফাইল চিত্র।
বিবেক অগ্নিহোত্রী মশাই সম্প্রতি ফুঁসে উঠেছিলেন। ইজ়রায়েলি চিত্রপরিচালক নাদাভ লাপিদ তাঁর কাশ্মীর ফাইলস ছবিটির সমালোচনা করায় যারপরনাই ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছিলেন বিবেক। সম্প্রতি জঙ্গিদের তরফে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের শাসানি দেওয়ার ঘটনায় তিনি আবার ময়দানে অবতীর্ণ হয়ে পাল্টা শাসানির সুরে বলেছেন, এর পরে যদি কাশ্মীরে কোনও হিন্দু খুন হন, তা হলে নিশ্চয় কারও বুঝতে অসুবিধা নেই, সেই রক্ত কার হাতে লেগে রয়েছে! অর্থাৎ, কেউ একটি ছবিকে খারাপ বলার জন্য কাশ্মীরে পণ্ডিতদের যদি প্রাণ চলে যায়, তার দায় প্রশাসনের নয়, রাজ্য বা কেন্দ্র কারও নয়, এক জন ভিনদেশি চিত্রপরিচালকের! ভারত সরকারের পক্ষে এটা ভাল বিজ্ঞাপন কি না, তা শাসকরাই বলতে পারেন।
গোয়া চলচ্চিত্র উৎসবে লাপিদ মুখ খোলার পরে তাঁর নিন্দায় মুখর হয়েছিল কাশ্মীরের পণ্ডিতদের একাধিক সংগঠনও। ইতিমধ্যে মাসের শুরুর দিকে লস্কর-ই-তইবার মুখপত্র হয়ে কাজ করা একটি ব্লগে ৫৬ জন পণ্ডিত শিক্ষক, ৮ জন সাংবাদিক এবং কয়েক জন রাজনীতিকের একটি তালিকা প্রকাশিত হয়। জঙ্গিরা দাবি করে, এঁরা সকলেই তাদের নিশানায় রয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে হইচই হয় বিস্তর। চার সাংবাদিক ভয়ে কাজ ছেড়ে দেন। কেন্দ্রীয় সরকার উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে বসে এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পক্ষ থেকে আশ্বাস দিয়ে বলা হয়, সরকার এঁদের সুরক্ষার ভার নেবে। এর মধ্যে নাদাভ লাপিদের প্রসঙ্গ আসে কোথা থেকে? বুঝতে অসুবিধা নেই, তা আসে প্রতিহিংসা থেকে। লাপিদ মুখ খোলার সময় থেকেই ভক্তরা একটিই ফাটা রেকর্ড বাজিয়ে চলেছেন— কাশ্মীর ফাইলস-এ যা যা দেখানো হয়েছে, সে সব নির্জলা সত্যি। এই অবসরে জঙ্গিদের হুমকির খবর সামনে এসে যাওয়ায় তাঁরা ইউরেকা বলে লাফিয়ে পড়েছেন। কাশ্মীর ফাইলস-এর ন্যায্যতা প্রমাণের আরও একটি সুযোগ এসে গিয়েছে বলে মনে করছেন। ঘটনার সত্যাসত্যের সঙ্গে ছবির ভালমন্দের কোনও সম্পর্ক নেই, থাকতে পারে না, এ কথা তাঁদের অজানা নয়। তা সত্ত্বেও ভক্তদের এই আস্ফালন দেখে বোঝা যায়, তাঁরা আদতে এও জানেন যে, কাশ্মীরের পরিস্থিতির অনেকগুলি সত্য তাঁদের ছবিতে নেই। ছবিতেও নেই, তাঁদের এখনকার চেঁচামেচিতেও নেই।
সত্য অনুপস্থিত, কারণ সত্য অপ্রিয়। ২০১০ সালে জম্মু কাশ্মীর সরকার বিধানসভায় জানিয়েছিল, ১৯৮৯ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে ২১৯ জন পণ্ডিত খুন হয়েছেন। ২০০৪ থেকে ২০১০-এর মধ্যে কোনও পণ্ডিত নিহত হননি। এর পর গত বছর ডিসেম্বর মাসে কাশ্মীর পুলিশ একটি আরটিআই-এর জবাবে জানায়, ১৯৯০ থেকে ২০২১ পর্যন্ত কাশ্মীরে ৮৯ জন পণ্ডিত খুন হয়েছেন, অহিন্দু খুন হয়েছেন ১৭২৪ জন। স্পষ্টতই ১৯৮৯-এর পরিসংখ্যান এর মধ্যে নেই। কিন্তু একটা বিষয় খুব পরিষ্কার যে, কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদের জেরে শুধু পণ্ডিতরাই খুন হয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন, তা নয়। পণ্ডিতদের প্রতি অন্যায়, অবিচার, উপত্যকা থেকে তাঁদের উৎখাতের ট্র্যাজেডিকে এতটুকু খাটো না করেও কথাটা বলা দরকার। বর্তমান সরকার পণ্ডিতদের প্রসঙ্গ বার বার তোলে বটে, কিন্তু এও একটু খতিয়ে দেখা দরকার যে পণ্ডিতদের সুরক্ষায় তারা ঠিক কী করেছে। এপ্রিল মাসে রাজ্যসভায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়েছে, ৩৭০ ধারা রদ হওয়ার পর থেকে ১৪ জন পণ্ডিত কাশ্মীরে নিহত হয়েছেন। অর্থাৎ, ৩৭০ ধারার রদ পণ্ডিতদের বিপদ বাড়িয়েছে বই কমায়নি। ৫৬ জন পণ্ডিত শিক্ষককে সুরক্ষার জন্য স্থানান্তরিত করতে হয়েছে। তার পরেও তাঁদের নামের তালিকা জঙ্গিদের হাতে চলে গিয়েছে। এ ব্যর্থতার দায় প্রশাসন ছাড়া আর কার? সেই সত্য আড়ালে রাখতে হলে নাদাভ লাপিদকে নিয়েই হইচই চালিয়ে যাওয়া দরকার বটে। ভক্তরা সেই দরকারি কাজটাই করছেন।