কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া। ছবি: পিটিআই।
শিক্ষার ক্ষেত্রে রাজ্য নিজস্বতা বিসর্জনের পক্ষপাতী নয়— স্পষ্ট ভাবেই জানিয়ে দিল কর্নাটক। সম্প্রতি বেঙ্গালুরুতে শিক্ষামন্ত্রী মধু বঙ্গারাপ্পা জানিয়েছেন, তাঁরা জাতীয় শিক্ষানীতি (এনইপি) ২০২০ গ্রহণের পরিবর্তে রাজ্য শিক্ষানীতি (এসইপি) প্রয়োগের পরিকল্পনা করছেন। কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়াও একই সুরে জানিয়েছিলেন— ভারতের মতো বৈচিত্রপূর্ণ দেশের সঙ্গে এক অভিন্ন শিক্ষানীতি চালুর ভাবনাটি খাপ খায় না। যে ভাবে তা প্রয়োগের চেষ্টা চলছে, তাও ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। যুক্তিগুলি অতি সঙ্গত। ইতিপূর্বে এনইপি ২০২০ চালুর ভাবনা এবং তার প্রয়োগগত ত্রুটিগুলির কথা বহু আলোচিত হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতির পাঠ্যসূচিতে আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য ও ইতিহাসের অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ার প্রসঙ্গটিও উঠে এসেছে। তা ছাড়া, ভারতীয় সংবিধানে শিক্ষা যৌথ অধিকারভুক্ত। অথচ, রাজ্যগুলির সঙ্গে কোনও আলোচনা না করে একতরফা ভাবে এই নীতি চালুর বিষয়ে পূর্বেই সরব হয়েছিল কেরল, তামিলনাড়ু, পশ্চিমবঙ্গ, তেলঙ্গানার মতো বিরোধী-শাসিত রাজ্য। কর্নাটকের পূর্বতন বিজেপি সরকার তখন সেই বিরোধিতায় নাম লেখায়নি। সে রাজ্যে পট-পরিবর্তন ঘটল সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনের পর। বোঝা গেল, নবগঠিত কংগ্রেস সরকার শিক্ষার ক্ষেত্রে কেন্দ্রের চাপিয়ে দেওয়া নীতির পথে চলতে রাজি নয়।
জাতীয় শিক্ষানীতি প্রত্যাহার প্রসঙ্গে কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী ভারতের ধর্মীয় বৈচিত্রের যে কথাটি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, তা আলাদা উল্লেখের দাবি রাখে। বাস্তবিকই, জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণেতারা এই নীতির উদ্দেশ্য হিসাবে ভারতের গৌরবময় অতীত এবং জ্ঞানকে শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে নতুন ভাবে আবিষ্কার করার কথা যে ভাবে প্রচার করেছেন, তার ভিতরে হিন্দুত্ববাদকে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াসটি অতি বিপজ্জনক। স্কুলের পাঠ্যসূচি থেকে ইতিমধ্যেই বাদ পড়েছে মোগল ইতিহাসের অধ্যায়, বাদ পড়েছে ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বও। ছাত্রদের গণিতের সঙ্গে বেদাঙ্গ জ্যোতিষ, চিকিৎসাশাস্ত্রের সঙ্গে আয়ুর্বেদ, যোগ পড়াতে বলা হচ্ছে— যেগুলি আলাদা করে ক্ষতিকর না হলেও অন্যান্য পাঠ্যসূচি সংস্কারের সঙ্গে মিলে তার যে অর্থ তৈরি হচ্ছে— তা ভয়ানক। তার সঙ্গে রয়েছে অবৈজ্ঞানিক, অযৌক্তিক সংস্কারবিষয়ও: আইআইটি-তে গো-বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনাচক্র আহ্বান, এমস-এর চিকিৎসকের ‘গর্ভসংস্কার’-এর সপক্ষে জোরালো সওয়াল যে একুশ শতকের জাতীয় শিক্ষায় জায়গা নিতে পারে, তা অভাবনীয়। ‘হিন্দু সভ্যতা’র মূল্য বর্ণনা করা এবং সেই সভ্যতাকে সেরা প্রমাণের জন্য তার পশ্চাৎমুখী সংস্কারসমূহকে উদ্যাপন করা এবং অন্যান্য অবদান মুছে দেওয়া এক নয়। কেবল বিরোধী রাজনীতিকরা নন, শিক্ষাবিদরাও এ সবে চূড়ান্ত বিপন্ন বোধ করছেন।
কর্নাটকের আপত্তির সূত্রে উঠে এসেছে আর একটি কথাও। এই নতুন শিক্ষানীতি বেসরকারি উদ্যোগকে অবাধ স্বাধীনতা দেবে, আশঙ্কা এমনই। ফলে আগামী দিনে আরও মহার্ঘ হবে শিক্ষা, বঞ্চিত হবে দরিদ্র প্রান্তিক ছাত্রছাত্রীদের। সুতরাং, কর্নাটকের মতো রাজ্যের নিজ শিক্ষানীতি প্রয়োগের ভাবনাটি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু জরুরি প্রশ্ন থেকে যায়, এর ফলে রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার অনুসারীদের সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা রইল না কি?