যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। —ফাইল চিত্র।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে র্যাগিংয়ের জেরে এক ছাত্রের মৃত্যুর ন’মাস পর দোষীদের শাস্তি নির্ধারণ করল বিশ্ববিদ্যালয় কর্মসমিতি। চার ছাত্রকে বহিষ্কার, পাঁচ ছাত্রকে চার সিমেস্টারের জন্য এবং ২৫ জন ছাত্রকে একটি সিমেস্টারের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে; এই ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেল থেকেও বহিষ্কৃত হয়েছে। এঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র সংসদের তিন নেতার বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা করা হয়েছে। ৯ ও ১০ অগস্ট ২০২৩, অভিযুক্তরা যে ভয়ানক নির্যাতন করে এক নবীন সহপাঠীকে, এবং তদন্ত বিপথে চালানোর চেষ্ট করে, তার জন্য কঠোর শাস্তিই প্রাপ্য। ওই মর্মান্তিক ঘটনার পরে তদন্তে ধরা পড়ে, ধারাবাহিক এবং সুপরিকল্পিত নির্যাতন কার্যত ওই হস্টেলের ‘সংস্কৃতি’ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই দুর্বৃত্তায়নের কুচক্র থামাতে হলে বহিষ্কারের মতো কঠোর ব্যবস্থারই প্রয়োজন। তবু কিছু প্রশ্ন থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক ও কর্মচারীদের গাফিলতির জন্য দীর্ঘ দিন ধরে র্যাগিংয়ের ঘটনা প্রায় ধারাবাহিক ভাবে ঘটতে পেরেছে, তাঁদের শাস্তির কী ব্যবস্থা হবে? হস্টেলের নিরাপত্তা ব্যবস্থার শিথিলতার সুযোগ নিয়েই কিছু ছাত্র ভয়ানক আতঙ্কের আবহ তৈরি করে রাখতে পেরেছিল। কিন্তু সেই অব্যবস্থা চলতে দেওয়ার দায় কি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নয়? বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্তে প্রকাশ, হস্টেল সুপারিনটেনডেন্টরা মেন হস্টেলের ‘এ টু’ বিভাগে যেতে ভয় পেতেন, কারণ পরিদর্শনে গিয়ে তাঁরা নানা ভাবে নিগৃহীত হয়েছেন। এমন একাধিক ঘটনার পরেও দুর্বৃত্ত ছাত্রদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা করেনি বিশ্ববিদ্যালয়। পাশ করে যাওয়ার পরেও হস্টেলের ঘর দখল করে রয়েছে, তা জানা সত্ত্বেও দখলকারী ছাত্রদের বার করতে পারেনি। সর্বোপরি, প্রথম বর্ষের ছাত্রদের আলাদা হস্টেলের ব্যবস্থা করতে হবে, ইউজিসি এই নিয়ম জারি করার এক দশকেরও বেশি পার হয়ে গিয়েছিল। অথচ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন হস্টেলে প্রথম বর্ষের ছাত্রদের রাখা হচ্ছিল সিনিয়রদের সঙ্গে, আলাদা কোনও উদ্যোগই করা হয়নি।
এই গুরুতর গাফিলতিগুলির দায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অস্বীকার করতে পারেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসমিতি যে তদন্ত-রিপোর্টের সুপারিশগুলি গ্রহণ করেছে, সেখানে শিক্ষক ও কর্মচারীদের গাফিলতি সম্পর্কে কী বলা হয়েছে, এবং কী ধরনের শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে, তা এখনও পর্যন্ত সংবাদে আসেনি। একাধিক কমিটি বিষয়টি বিবেচনা করেছে, সেগুলির মধ্যে সমন্বয়ও সামান্য। হতে পারে, বিষয়টি এখনও বিবেচনাধীন। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠবে যে, দীর্ঘ ন’মাস সময় পেয়েও কেন তদন্তের এই গুরুত্বপূর্ণ অংশটি অসম্পূর্ণ থেকে গেল? যে ভাবে তদন্ত চলেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরেই তার প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি নিয়ে বার বার প্রশ্ন উঠেছে। অন্তর্বর্তিকালীন তদন্ত কমিটি গঠন করা উচিত কি না, তা নিয়ে বিতর্ক উঠেছিল। সেই তদন্ত রিপোর্টই প্রথমে অ্যান্টি-র্যাগিং স্কোয়াডের কাছে পেশ হয়, পরে পেশ হয় অ্যান্টি-র্যাগিং কমিটির কাছে। যে রিপোর্ট শেষ অবধি পেশ হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসমিতির কাছে, যার ভিত্তিতে ছাত্রদের শাস্তি ঘোষিত
হয়েছে, সেখানে আর কী কী পদক্ষেপের সুপারিশ রয়েছে, তা প্রকাশ করা হয়নি।
তদন্তাধীন ঘটনার দায় কি অ্যান্টি-র্যাগিং কমিটির উপরেও বর্তায় না? কমিটির সদস্যরা যদি বদলে গিয়েও থাকেন, তা হলেও পুরনো কমিটির সদস্যদের কাজে কী গাফিলতি, ব্যর্থতা ছিল, তা জানা দরকার। ছাত্রমৃত্যুর ঘটনার পরে তদন্তে প্রকাশ পেয়েছে যে, ২০১৮-১৯ সাল থেকে অন্তত আঠারোটি র্যাগিংয়ের ঘটনার অভিযোগ ছিল, তা সত্ত্বেও র্যাগিং প্রতিরোধে তৎপর হননি কর্তৃপক্ষ। অতএব সেই সময়কালে ছাত্র-নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বিভিন্ন শিক্ষক-আধিকারিকের ভূমিকার বিশদ তদন্ত হওয়া দরকার। সে বিষয়ে কী পদক্ষেপ হয়েছে? র্যাগিংয়ের মতো ভয়ঙ্কর ঘটনার তদন্তে বিলম্ব ও অস্বচ্ছতা দুর্ভাগ্যজনক।