PM Narendra Modi

সঙ্কল্পের অন্তরালে

ব্যক্তিতন্ত্রের এই মৌলিক রীতি অনুসরণ করেই চিরাচরিত নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বা নতুনতর সঙ্কল্প উচ্চারণে সন্তুষ্ট না থেকে দেশের প্রধানমন্ত্রী অধুনা ডাইনে-বাঁয়ে ‘গ্যারান্টি’ বিতরণ করে থাকেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০২৪ ০৯:১৩
Share:

—ফাইল চিত্র।

সঙ্কল্পপত্র নামটি এখনও বহাল আছে, তবে লোকসভা নির্বাচনের আগে প্রচারিত ভারতীয় জনতা পার্টির ইস্তাহারের পা থেকে মাথা পর্যন্ত যে বাণীর ক্লান্তিহীন বিরামহীন পুনরাবৃত্তি, তার নাম: ‘মোদী কী গারন্টী’। বিকশিত ভারত, সুরক্ষিত ভারত, বিশ্ববন্ধু ভারত ইত্যাদি নামাবলির পাশাপাশি গরিব পরিবার জন, মধ্যবিত্ত পরিবার জন, কৃষক, শ্রমিক, মৎস্যজীবী পরিবার, ছোট ও মাঝারি উদ্যোগী, ব্যবসায়ী এবং বিশ্বকর্মা, তরুণ নাগরিক, প্রবীণ নাগরিক, নারীশক্তি ইত্যাদি রকমারি বর্গের জন্য বিজেপির ইস্তাহারে সরবরাহ করা হয়েছে— দলের নয়— মোদীর গ্যারান্টি। দুর্জনে হয়তো বলবে যে, সাঙাততন্ত্রে যাদের জন্য প্রকৃত গ্যারান্টির বন্দোবস্ত থাকে, তাদের নাম এই তালিকায় উহ্য রাখা হয়েছে। দুর্জনের কথায় কান দিতে নেই, তবে দুনিয়ার বৃহত্তম গণতন্ত্রের পঞ্চবার্ষিকী মহোৎসবের এই মাহেন্দ্রক্ষণে দেশের শাসকরা একটি কথা আরও এক বার প্রবল নিনাদে ঘোষণা করলেন: সবার উপরে তিনিই সত্য, তাঁহার উপরে নাই। দলনায়ককে দলের উপরে, সরকারের উপরে, দেশের উপরে অধিষ্ঠিত করার যে রীতি এ দেশে গত দশ বছরে সুপ্রচলিত, শাসক দলের নির্বাচনী সঙ্কল্পের নথিটি তার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি বহন করছে। এক বিন্দু সংশয়ের জায়গা রাখা হয়নি যে, বিজেপির কাছে এই নির্বাচন নরেন্দ্র মোদীর নির্বাচন।

Advertisement

ব্যক্তিতন্ত্রের এই মৌলিক রীতি অনুসরণ করেই চিরাচরিত নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বা নতুনতর সঙ্কল্প উচ্চারণে সন্তুষ্ট না থেকে দেশের প্রধানমন্ত্রী অধুনা ডাইনে-বাঁয়ে ‘গ্যারান্টি’ বিতরণ করে থাকেন। এবং, তার প্রামাণ্যতা প্রতিষ্ঠা করার জন্য দশ বছরের জমানায় রামমন্দির নির্মাণ বা ৩৭০ ধারা বিলোপের মতো ‘কৃতিত্ব’গুলিকে সাড়ম্বরে পেশ করে জনসাধারণকে দেখাতে চাইছেন, তিনি যা বলেন তা-ই করেন। স্পষ্টতই, দেশের অর্থনীতির প্রকৃত অগ্রগতি বা সাধারণ মানুষের অবস্থার প্রকৃত উন্নতি ঘটানোর বনিয়াদি কর্তব্য সম্পাদনে তাঁর সরকারের রেকর্ড নিতান্তই নিষ্প্রভ। বিশেষত বিপুল বেকারত্ব এবং দ্রুত বর্ধমান আর্থিক অসাম্য— এই দু’টি প্রধান অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের বদলে ক্রমশই তীব্রতর আকার ধারণ করছে। অথচ এই বিষয়ে বিজেপির ইস্তাহারে যথার্থ কোনও সঙ্কল্প বা প্রতিশ্রুতিটুকুও নেই, যা আছে তার নাম গ্যারান্টির ঢক্কানিনাদ। এক দিকে দরিদ্র ভারতবাসীকে পাঁচ বছর বিনামূল্যে কিছু খাদ্যশস্য জোগান দেওয়ার কথা বলে এবং অন্য দিকে, ২০৩৬ সালে অলিম্পিক গেমস আয়োজনের ফানুস উড়িয়ে যাঁরা দারিদ্র, বেকারত্ব, অসাম্যে জর্জরিত একটি দেশের মানুষকে ভোলাতে চান, তাঁদের নির্বাচনী ইস্তাহার অনিবার্য ভাবেই ‘রুটি ও সার্কাস’-এর প্রাচীন নীতির কথা মনে পড়িয়ে দেয়।

প্রশ্ন উঠবে, আজ আর এ দেশে নির্বাচনী ইস্তাহারকে আদৌ গুরুত্ব দেওয়ার কোনও কারণ আছে কি? এখানেই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে এই সঙ্কল্পপত্রের মূল চরিত্রটির কথা। প্রধানমন্ত্রী কী গ্যারান্টি দিচ্ছেন বা সেই প্রতিশ্রুতির কতখানি সত্যই তাঁরা পূরণ করতে চান, সে-সব অবান্তর প্রশ্ন। প্রাসঙ্গিক এইটুকুই যে, সরকারের প্রকৃত কর্তব্য বা তার কৃতিত্বের যথাযথ মূল্যায়নের কোনও গুরুত্ব এই বিচিত্র নির্বাচনী রাজনীতিতে অবশিষ্ট নেই। শাসকদের লক্ষ্য তাঁদের আধিপত্যবাদী অভিযানকে অব্যাহত রাখা। নাগরিকত্ব আইন বলবৎ হবেই কিংবা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করা হবেই— ইত্যাকার গর্জনের মধ্য দিয়ে তাঁরা আপন সংখ্যাগুরুতন্ত্রের ইমারতটিকেই আরও জোরদার করে তুলতে চান। এই তন্ত্রের ভক্ত বা অনুসারী যাঁরা, তাঁদের কাছে উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিচার্য নয়, বিচার্য কেবল সংখ্যাগুরু আধিপত্যের জয়স্তম্ভ। বিজেপির ইস্তাহারে এই আধিপত্যবাদের অহঙ্কার কেবল সুস্পষ্ট নয়, প্রকট। প্রশ্নটা এ বার গণতন্ত্রের। আট দশকে পা দেওয়ার আগে ভারতীয় গণতন্ত্র সেই অহঙ্কারকে কত দূর অবধি বরণ করতে চায়, এই নির্বাচন তার এক বড় পরীক্ষা।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement