প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিটিআই।
ভারতও আয়োজন করবে বিশ্বকাপ ফুটবলের, ভরসা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বিশ্বকাপ নিয়ে মত্তবিধুর দেশবাসীর কর্ণকুহরে সেই আশ্বাস নিশ্চয় অশেষ সুধা সিঞ্চন করেছে। অন্যের জন্য করতালিই যখন দিতে হবে, তখন তা নিজের দেশের মাটিতে হলে সুবিধাজনক। গৌরবজনক তো বটেই। মেলে বহু বিদেশি অভ্যাগত, যাঁরা বিশ্বের যে কোনও প্রান্তে বিশ্বকাপ দর্শনের জন্য উন্মুখচিত্ত। মেলে অপরিমেয় আন্তর্জাতিক লাইমলাইট। এমনকি হাজারো সমালোচনার মধ্যেও আয়োজক হিসাবে কাতার কয়েক সপ্তাহ টানা দেশবিদেশের সংবাদজগতের হেডলাইন ও প্রাইম টাইম অধিকার করে রাখতে পেরেছে। উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে যে খ্যাতি ও স্বীকৃতির এই শর্টকাট রাস্তা আকর্ষণীয়, বুঝতে অসুবিধা নেই। সুতরাং, প্রধানমন্ত্রীর এ-হেন আশ্বাস সর্বার্থে সুখদায়ী। বস্তুত, সুখদানে নরেন্দ্র মোদী বরাবরই উদার, অকৃপণ। জি-২০’র শীর্ষস্থানের মতো রুটিন ভূমিকাগ্রহণেও তিনি যেমন বিশ্বনেতৃত্বের স্বপ্নে দেশবাসীকে বিভোর করে দিতে পারেন, বিশ্বকাপবিলাসী ভারতীয়কেও এক অনারব্ধ ভবিষ্যতের প্রেমপ্রতীক্ষায় আর্দ্রচিত্ত বানিয়ে দিতে পারেন। সবকা সাথ সবকা বিকাশ-ও তিনি বিশ্বাস করিয়ে দিতে পারেন, ভারতকে পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থব্যবস্থা হিসাবে গড়ে দেওয়ার ভবিষ্যদ্বাণীটিও আস্থাযোগ্য শোনাতে পারেন। কখনও পাঁচ বছরে কৃষকের আয় দ্বিগুণ করে দেওয়ার কথা বলেন। কখনও আবার ভারত অচিরেই উন্নত দেশ হয়ে ওঠার কথা বলেন। বিশ্বকাপ আয়োজন বিষয়ে তাঁর আশ্বাসবাণীটিও এই কথামালার আর একটি সংযোজন।
দুনিয়ার ইতিহাস একটি শিক্ষা দিয়েছে। যে শাসক যত একাধিপত্যকামী কর্তৃত্ববাদী, তিনি ততই কথামালা ও বিপুল আয়োজনের প্রতিশ্রুতিমালার প্রয়াসী। এমন অনুষ্ঠানের মাপ, জৌলুস এবং প্রতাপ এমনই মহাজাগতিক মাপের যে, তার পাশে অন্য সব প্রশ্নকেই অকিঞ্চিৎকর দেখাতে পারে, সম্ভবত এখানেই মহাকথামালার আকর্ষণ। বিশ্বকাপের আসর বাস্তবিক অনেক কিছু ঢাকার মতো ম্যাজিক চাঁদোয়া হয়ে উঠতে পারে। কাতার বিশ্বকাপই প্রমাণ যে, কূটনৈতিক এবং আর্থিক তাসগুলি গুছিয়ে খেলতে পারলে ফুটবল খেলায় কিছুমাত্র প্রমাণিত কৃতিত্ব ব্যতিরেকেই সেই আসর আয়োজনের দায়িত্ব পাওয়া যেতে পারে।
টাকার জোরে কাতারের সঙ্গে ভারতের কোনও তুলনা চলে না। অতএব, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার প্রেক্ষিতে গোটাকয়েক প্রশ্ন তোলা জরুরি। প্রথম প্রশ্ন, যে খেলায় গোটা দুনিয়ায় ভারতের র্যাঙ্ক একশোরও নীচে, কয়েক হাজার কোটি ডলার ব্যয় করে বিশ্বকাপ আয়োজনের কথা ভাবার সামর্থ্যও কি তার রয়েছে? দ্বিতীয় প্রশ্ন, যদি আর্থিক সাধ্য থাকেও, তবুও শুধু অন্য দলের খেলা দেখার জন্য বিশ্বকাপের আয়োজন করা মানে কি জগৎসভায় নিজেদের হাস্যাস্পদ করে তোলা নয়? একশো চল্লিশ কোটি মানুষের দেশ থেকে এমন একটা ফুটবল টিম তৈরি করা সম্ভব হয় না, যা বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে— এই লজ্জা লুকানো অসম্ভব। খেলার আয়োজক দেশ হলে সেই সুবাদে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারবে ভারত, কিন্তু তার পর? সবচেয়ে গোড়ার প্রশ্নটি হল, যে দেশ এমন ফুটবল পাগল, সেখানে কেন বিশ্বমানের দল তৈরি করা সম্ভব হয় না? এ প্রশ্ন শুধু প্রধানমন্ত্রী মোদীকে নয়। পঁচাত্তর বছরে কখনও চেষ্টা হয়নি উপযুক্ত প্রশিক্ষণে বিশ্বমানের খেলোয়াড় তৈরি করার। তবে প্রশ্নটি প্রধানমন্ত্রীর দিকেও বটে: গত সাড়ে আট বছরের সরকারও কি এমন কোনও চেষ্টা দেখিয়েছে? বরং তার বদলে কথামালা দিয়ে কাজ চালানো এবং ভুয়ো আশ্বাসবাণী বিতরণ করার অভ্যাস রপ্ত করা হয়েছে। কৌশল হিসাবে উত্তম: এতে খরচ কম, কিন্তু জনমানসে সুবাতাস বইয়ে দেওয়ার প্রাপ্তিটি বিপুল।