ফাইল চিত্র।
দিনকয়েক পূর্বে দেশের খুচরা ব্যবসায়ীদের একটি সংগঠন সরকারের নিকট আবেদন করিয়াছিল— কোভিড-এর দ্বিতীয় প্রবাহ ঠেকাইতে যেন ফের সার্বিক লকডাউনের পথে না হাঁটা হয়। আবারও লকডাউন হইলে তাঁহাদের ব্যবসা বাঁচাইবার আর কোনও উপায় থাকিবে না। শুধু খুচরা ব্যবসায়ীরাই নহেন, আরও এক দফা লকডাউন হইলে ভারতবাসীর সিংহভাগ ধনেপ্রাণে মারা পড়িবেন বলিয়াই আশঙ্কা। আশার কথা, সরকারও সম্ভবত পরিস্থিতিটি সম্বন্ধে অবহিত। ফলে, দ্বিতীয় প্রবাহ ঠেকাইতে গত বৎসরের ন্যায় কঠোর লকডাউনের কোনও পরিকল্পনা এখনও শোনা যায় নাই। অবশ্য, সিঁদুরে মেঘটুকুও না দেখিয়া ভয় পাইবার কারণ ভারতবাসীর আছে— রাত্রি আটটায় জাতির উদ্দেশে ভাষণের বিভীষিকাগুলি সচরাচর পূর্বাভাস ভিন্নই ঘটিয়া থাকে। কিন্তু, এই কথাটি অনস্বীকার্য যে, গত বৎসরের কঠোরতার পুনরাবৃত্তি করিবার বিপদ এই দফায় স্পষ্টতর, এবং গভীরতরও বটে। ২০২০ সাল ভারতীয় অর্থব্যবস্থাকে যে ভাবে ধ্বস্ত করিয়াছে, তাহার আর নূতনতর আঘাত সহিবার সামর্থ্য নাই। দ্বিতীয় প্রবাহের সহিত যুদ্ধে ইহাই ভারতের সম্মুখে বৃহত্তম চ্যালেঞ্জ— অর্থব্যবস্থাকে স্থবির না করিয়া অতিমারির মোকাবিলা করিতে হইতেছে।
তাহার উপরে আছে পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। তাহার প্রচারপর্ব যেমন চলিতেছে, তেমনই নির্বাচন প্রক্রিয়াটি চালাইতেও প্রচুর লোক প্রয়োজন। স্বস্তির কথা যে, আর এক মাসের মধ্যে সেই পর্ব মিটিবে— কিন্তু তত দিনে অনেক দেরি হইয়া যাইবে কি না, সেই প্রশ্ন থাকিতেছে। অর্থব্যবস্থাকে চালাইয়া লইতে হইলে অফিসকাছারি, কলকারখানাও চলিবে। বাস-ট্রেনে লোকে যাতায়াত করিবেন। দোকানপাটও চলিবে। যাঁহারা অতিমারি সম্পূর্ণ বিস্মৃত হইয়া কোনও রকম সুরক্ষার তোয়াক্কা না করিয়াই রাস্তায় নামিয়া পড়িয়াছেন, তাঁহাদের কথা ভিন্ন— কিন্তু, যাঁহারা এই রোগ হইতে আত্মরক্ষা করিতে চাহেন, তাঁহাদের বাঁচিবার উপায় কোথায়? বিনোদনের প্রশ্ন নাহয় বাদ দেওয়া গেল, সন্তানের স্কুল-কলেজও নাহয় বন্ধই থাকিল— কিন্তু, অর্থনৈতিক উৎপাদন যদি চলিতে থাকে, সেই প্রক্রিয়ায় যোগ না দিয়া কর্মজীবী মানুষের উপায় কী? নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করিবার সব চেষ্টা নাগরিককে করিতেই হইবে— বিশেষত, মাস্ক না পরিবার হঠকারিতা নৈব নৈব চ। কিন্তু, তাহাতেও কি বিপদ সম্পূর্ণ ঠেকানো যাইবে? অর্থব্যবস্থার চাকাকে আরও এক বার স্তব্ধ হইতে দেওয়া চলিবে না, আবার শ্রমশক্তিকেও নিরাপত্তা দিতে হইবে— সরকার ও প্রশাসনের উপর এখন এই জোড়া দায়িত্ব ন্যস্ত।
গামলার নোংরা স্নানের জলের সঙ্গে শিশুটিকেও ফেলিয়া দিবার রাষ্ট্রীয় কু-অভ্যাসটি যদি এই বার বিদায় হয়, তবে মঙ্গল। বিশেষত, গত দফার কড়াকড়িতে যে বাড়তি লাভ হইয়াছে, তাহার কোনও প্রমাণ নাই। লকডাউনের কঠোরতায় বিশ্বে সর্বাগ্রগণ্য হইলেও এশিয়ার আঞ্চলিক সুবিধাটুকু বাদ দিলে কোভিডে মৃত্যুর হারে ভারত কিন্তু অন্যদের তুলনায় মন্দই করিয়াছে। অতএব, এই দফায় ভাবিতে হইবে, কোন পথে হাঁটিলে অর্থব্যবস্থাকে বাঁচাইয়াও অতিমারির প্রকোপ ঠেকানো চলে। তাহার একটি পন্থা নিঃসন্দেহে যত দ্রুত সম্ভব মানুষের জন্য প্রতিষেধকের ব্যবস্থা করা। যত সংখ্যক মানুষের টিকাকরণ হইলে অতিমারির শৃঙ্খলটিকে ভাঙা সম্ভব হইবে, সেই সংখ্যায় দ্রুত পৌঁছাইবার রাষ্ট্রীয় বন্দোবস্তটি পাকা করা প্রয়োজন। সংক্রমণের প্রাবল্যের নিরিখে অঞ্চল চিহ্নিত করিয়া স্থানীয় ভাবে লকডাউন করিবার পন্থাটিও ফের ব্যবহার করা চলে কি না, তাহাও ভাবিতে হইবে। এবং, সিদ্ধান্ত করিতে হইবে স্থানীয় প্রশাসনের সহিত আলোচনার ভিত্তিতে। অর্থব্যবস্থার কোন সূত্র কোথায় বাঁধা, দূর হইতে তাহা বোঝা কঠিন। গত বারের ভুলের পুনরাবৃত্তি না করাই বাঞ্ছনীয়।