ভারতীয় দল। —ফাইল চিত্র।
দশটি ম্যাচ অপরাজিত থেকে ফাইনালে গিয়ে পরাজয়। যে দলকে মনে হচ্ছিল অপ্রতিরোধ্য, বারো বছর পর বিশ্বকাপ জয়ের অবিসংবাদিত দাবিদার, তারাই চূড়ান্ত ম্যাচে এমন ভাবে হারল যে, বিস্ময় চাপা থাকছে না। পরাজয় কে-ই বা মানতে পারে— বিশেষত গোটা টুর্নামেন্টে প্রতিপক্ষদের একের পর এক ম্যাচে উড়িয়ে দেওয়ার পরে, শেষ ম্যাচে এমন হার। রবিবার রাতে টিভির পর্দায় ক্রিকেট-তারকাদের সজল চোখ, বিষণ্ণ মুখ, ভেঙে-পড়া শরীরভাষা বলে দিচ্ছিল, এ যেন শুধু একটি প্রতিযোগিতার ফাইনালে পরাজয়ের ব্যর্থতা নয়, ভারত নামের একটা দেশকে, একটা গোটা জাতিকে সম্মান এনে দিতে না পারার ব্যর্থতা। যেন এ একটা খেলায় হার নয়, যুদ্ধে হার।
খেলায় হার-জিত থাকবেই। ক্রিকেটবোদ্ধা বা আবেগ-থরথর ভক্তও জানেন, দিনের শেষে, ইতিহাসের বিচারে বিশ্বকাপ ফাইনাল স্রেফ একটি দিনের একটা ম্যাচ মাত্র। ‘টিম ইন্ডিয়া’র কেউ ইচ্ছে করে খারাপ খেলেননি, বিপক্ষের মতো তাঁরা সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি, এই যা। কিন্তু তাঁদের এই হারকে গোটা দেশবাসী দেখছে সম্পূর্ণ ভিন্ন, অযৌক্তিক ও অশিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গিতে: ভারতীয় দল দেশ ও জাতির সম্মান রক্ষায় ব্যর্থ। খেলাকে শুধু মাঠের বাইরে নিয়ে আসাই নয়, তার সঙ্গে দেশ, জাতি ও জাতীয়তাবাদকে সেঁটে দেওয়াই এই ভারতীয়দের ‘কীর্তি’। ভারতীয় ক্রিকেট-জনতা এই কদাচরণ করে আসছেন বছরের পর বছর: দলকে হারতে দেখলেই তাঁরা স্টেডিয়ামে আগুন জ্বালান, ইট-পাটকেল বৃষ্টিতে ম্যাচ ভন্ডুল করেন, দল গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিলে অধিনায়কের বাড়ি আক্রমণ করেন, তাঁদের ‘ভয়ে’ ক্রিকেটারদের লুকিয়ে বিমানবন্দর ছাড়তে হয়। এ বছর এখনও অবধি এগুলি হয়নি, তা যেমন ইতিবাচক, তেমনি উল্টো দিকে এ-ও শেখার: নিউ জ়িল্যান্ড বা দক্ষিণ আফ্রিকাবাসীর কাছে সেমিফাইনালে হার জাতির অস্তিত্বসঙ্কট হয়ে দাঁড়ায়নি, অস্ট্রেলিয়াও বিশ্বকাপ পেয়ে ‘কী হেরিলাম’ বলে কেঁপে যায়নি, সর্বোচ্চ স্তরের এক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় জয়ী হলে যে উচ্ছ্বাসটুকু স্বাভাবিক সেটুকুই দেখিয়েছে।
ভারতীয় দল সম্প্রতি বেশ কয়েকটি আইসিসি টুর্নামেন্টের ফাইনালে চাপের মুখে কেন বার বার ভেঙে পড়ছে, তার ক্রিকেটীয় কারণ সন্ধান ও যথাযোগ্য মেরামতের দাবি না তুলে যে দেশ বিশ্বকাপে হারকে জীবন-মরণের, মান-সম্মানের প্রশ্ন করে তোলে, সেই দেশ ক্রিকেটারদের জন্য বিপজ্জনক। এই বিপজ্জনক অভ্যাসে যে আজকের জাতীয়তাবাদী রাজনীতিও এক প্রত্যক্ষ ইন্ধন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রধানমন্ত্রী থেকে শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীরা বিশ্বকাপ জয়কে দেখেন যুদ্ধের ‘রূপক’-এ, তাঁদের সুভাষিতগুলি অষ্টপ্রহর উগ্র জাতীয়তাবাদে ছেঁকে তোলা। ক্রিকেটভক্তের বহুলাংশ সেই কুপ্রভাবই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিচ্ছেন ‘টিম ইন্ডিয়া’র হার-জিতের প্রশ্নে। এ ভাবে আর যে সিদ্ধিই হোক, ক্রিকেটের স্বার্থসিদ্ধি হবে না। মাঠের ব্যর্থতাকে দেশের ব্যর্থতার সমার্থক ধরে নিলে ক্রিকেটাররা মরমে মরে থাকবেন; শুধু বিরাট কোহলি রোহিত শর্মা মহম্মদ শামিরাই নন, ভবিষ্যতে জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন দেখা প্রতিভাধর মাত্রেই দেশের অযৌক্তিক প্রত্যাশার ভারে ভেঙে পড়বেন, খেলা শুরুর আগেই। সে-ই হবে প্রকৃত পরাজয়। দরকার খেলাকে খেলা হিসাবে দেখতে শেখা, উগ্র জাতীয়তার দুর্বহ ভার থেকে তার নিঃশর্ত মুক্তি।