India and Bharat Controversy

জুজুর ভয়ে

ভারত, ইন্ডিয়া, হিন্দুস্থান— কোন নামে কখন দেশকে অভিহিত করবেন, সঙ্ঘ পরিবারের মন্ত্রী-সান্ত্রি-নেতা-গুরুরা সেটা নিজেরা অথবা তাঁদের বক্তৃতা-লেখকরা ঠিক করে নিয়েছেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৫:৪৩
Share:

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ছিয়াত্তর বছর পার হয়েছে, সংবিধানের বয়সও তিয়াত্তর অতিক্রান্ত। এই দীর্ঘ জীবনে হাজার সমস্যায় দেশ নাজেহাল হয়েছে, হয়ে চলেছে, পুরনো সমস্যার সঙ্গে ক্রমাগত যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন সমস্যার বোঝা। কিন্তু নিজের নাম নিয়ে তার কোনও সমস্যা আছে বলে এত কাল জানা ছিল না। দেশবাসীও জেনে এসেছেন, যাহা ইন্ডিয়া তাহাই ভারত। প্রসঙ্গ, প্রয়োজন বা নিজস্ব অভিরুচি অনুযায়ী বরাবর দুই নামই ব্যবহৃত হয়েছে, কারও তা নিয়ে কোনও অসুবিধা হয়েছে বলে কস্মিন্‌কালেও শোনা যায়নি। কৃত্রিম যন্ত্রমেধাকেও ইন্ডিয়ার তর্জমা করতে বললে সে অনায়াসে জবাব দেবে: ভারত। এহ বাহ্য, এমনকি শহর থেকে রেল স্টেশন অবধি সব কিছুর নাম বদলে হিন্দুত্বের নামাবলি রচনায় প্রবল উৎসাহী নরেন্দ্র মোদী সরকারও প্রায় এক দশক যাবৎ ‘ইন্ডিয়া দ্যাট ইজ় ভারত’ নিয়ে দিব্য রাজ্যপাট চালাচ্ছে। ভারত, ইন্ডিয়া, হিন্দুস্থান— কোন নামে কখন দেশকে অভিহিত করবেন, সঙ্ঘ পরিবারের মন্ত্রী-সান্ত্রি-নেতা-গুরুরা সেটা নিজেরা অথবা তাঁদের বক্তৃতা-লেখকরা ঠিক করে নিয়েছেন।

Advertisement

এরই মাঝে গোল হল কি— সহসা বিজেপি-বিরোধী দলগুলি একজোট হতে উদ্যোগী হল এবং অচিরেই সেই সমন্বয়ের মঞ্চটির নামকরণ হল: ইন্ডিয়া। এই নামের অভিঘাতে প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর সতীর্থরা গোড়া থেকেই বিচলিত হয়ে পড়েছেন, সেটা আজ সর্বজনবিদিত। তুচ্ছতাচ্ছিল্য এবং ব্যঙ্গবিদ্রুপ থেকে শুরু করে ‘কিছু কিছু সন্ত্রাসী সংস্থার নামেও তো ইন্ডিয়া থাকে’ গোছের উক্তি করে কুরুচির অবিশ্বাস্য নজির রচনা অবধি কিছুই তাঁরা বাকি রাখেননি। কিন্তু প্রতিস্পর্ধী ইন্ডিয়া-র অগ্রগতি রুদ্ধ হয়নি, বরং নানা দ্বন্দ্ব সত্ত্বেও, কিংবা সেই সব দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েই বিরোধী দলগুলির সমন্বয় ক্রমশ দানা বাঁধছে। অনুমান করা যায়, এই প্রক্রিয়ার ব্যস্ত অনুপাতে শাসকের মনে ভয় বাড়ছে। তাঁদের ঘুমে জাগরণে ইন্ডিয়া-র জুজু ক্রমশ অতিকায় আকার ধারণ করছে। সেই জুজুর ভয় এতটাই প্রবল যে তাঁরা একেবারে দেশের নাম থেকে ইন্ডিয়াকে বিতাড়ন করতে তৎপর হয়ে উঠেছেন। প্রেসিডেন্ট অব ইন্ডিয়া এবং ভারতের রাষ্ট্রপতি এত কাল এক সঙ্গে কাল কাটিয়েছেন, আজ হঠাৎ, আক্ষরিক অর্থে রাতারাতি, প্রেসিডেন্ট অব ভারত নামক মিশ্রভাষার উদয় হল। এমন খিচুড়ি রান্নার দৌড় যে কোথায় গিয়ে থামবে, তা বোধ হয় নরেন্দ্র মোদীরা নিজেরাও জানেন না।

সম্ভবত জানতে চানও না। তাঁরা রাজনীতির ময়দানে একটি অপ্রত্যাশিত গোলযোগ— বাণিজ্যিক দুনিয়ার পরিভাষায় ‘ডিজ়রাপশন’— সৃষ্টি করে সস্তা জনপ্রিয়তার ফসল তুলতে চাইছেন। ইন্ডিয়া বিদায়ের তৎপরতা যদি এখনই সংবিধান সংশোধন অবধি না পৌঁছয়, অবাক হওয়ার কিছু নেই। ইন্ডিয়া ‘বনাম’ ভারত নামক সংঘাতটিকে বিরোধীদের হেয় করার অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করাই শাসকদের প্রধান লক্ষ্য। কোনও যথার্থ বিতর্ক এই কুরাজনীতির উদ্দেশ্য নয়। লক্ষ্য, জল ঘোলা করা। ‘বিদেশি ইন্ডিয়া’র বিরুদ্ধে ‘স্বদেশি ভারত’কে লড়িয়ে দিয়ে সেই উদ্দেশ্য সিদ্ধির পথে এক লাফে নির্বাচনী সমুদ্র লঙ্ঘনের নকশা তৈরি হচ্ছে কি না, সেই প্রশ্ন অত্যন্ত সঙ্গত। এই নকশা কার্যকর হলে যে নিজেদের অন্যায় এবং অক্ষমতা থেকে জনসাধারণের নজর সরিয়ে রাখারও বিরাট সুযোগ মেলে, শাসকরা অবশ্যই সেই হিসাবও কষছেন। বিরোধীরা এই খেলাটি কতটা দক্ষ ভাবে খেলতে পারেন, সেটা এখন তাঁদের পরীক্ষা। তাঁরা স্বল্পবুদ্ধি হঠকারিতার বশবর্তী হয়ে ওই ‘বনাম’-এর ফাঁদে পা বাড়িয়ে দেন, না ইন্ডিয়া এবং ভারত দুইয়ের স্বাভাবিক এবং ঐতিহাসিক সহ-অবস্থানকে পরিপূর্ণ সম্মান জানিয়ে এই অবান্তর তরজা থেকে নিজেদের দূরে রেখে দেশের প্রকৃত সমস্যাগুলির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে পারেন এবং শাসকদের অগণন অপদার্থতা ও অন্যায়ের প্রতিবাদে তৎপর থাকতে পারেন, সেটাই প্রশ্ন। সেই প্রশ্ন ইন্ডিয়ারও, ভারতেরও।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement