ফের মে মাস। ফের ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব। বস্তুত, বিগত কয়েক বছরে প্রাক্-বর্ষা মরসুমে বঙ্গভূমিতে ঘূর্ণিঝড়ের হানা এক প্রকার নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আয়লা, আমপান, ইয়াসের ধ্বংসলীলার স্মৃতি এখনও ফিকে হয়নি, এর মধ্যেই সাম্প্রতিকতম ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে ফের বিপর্যস্ত হল পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ উপকূল। রেমাল সরাসরি এ রাজ্যে আঘাত হানেনি। কিন্তু বাংলাদেশের ভূমি স্পর্শ করা ঝড়ের ‘লেজের ঝাপটা’র যে প্রবল প্রভাব উপকূলবর্তী এলাকায় অনুভূত হয়েছে, তা ভয়ের। বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে সামুদ্রিক ঝড়ের সংখ্যা এবং তীব্রতা উভয়ই বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কার কথা বহুশ্রুত। প্রতি বছর বর্ষাশুরু অথবা বর্ষাশেষে ঘূর্ণিঝড়ের আগমন সেই আশঙ্কাকেই সত্য প্রমাণ করেছে। এক ঝড়ের ক্ষতি সামলে না-উঠতেই পরবর্তী ঝড়ের মোকাবিলার প্রস্তুতি শুরু করতে হচ্ছে। এ বড় সুখের সময় নয়।
রেমালের কারণে শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গে মৃতের সংখ্যা ছুঁয়েছে ৭। সরকারি সূত্রেই জানা গিয়েছে, রাজ্যে ২,৫০০টি বাড়ি পুরোপুরি এবং প্রায় ২৭,০০০ বাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর পাশাপাশি চাষের জমিতে জল ঢুকে, বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে পড়ে, চলাচলের রাস্তায় গাছ পড়ে যে অবর্ণনীয় দুরবস্থার জন্ম হয়েছে, তা ভয়ঙ্কর। কলকাতা বিমানবন্দর বন্ধ থেকেছে ২১ ঘণ্টা। অভূতপূর্ব ভাবে মেট্রোরেলের পাতালপথে জল প্রবেশ করে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ব্যাহত হয়েছে পরিষেবা, চলেনি লোকাল ট্রেনও। রবিবার রাতে ঝড় আছড়ে পড়ার পরও সোমবার গোটা দিনের ঝড়বৃষ্টিতে জল জমে, পর্যাপ্ত সংখ্যক গণপরিবহণ পথে না বেরিয়ে থমকে দিয়েছে সাধারণ মানুষের জীবনকে। প্রতি বার এই তীব্রতার ঝড়-জলের শেষে এটাই পরিচিত চিত্র। তিলে-তিলে বহু বছরের পরিশ্রমে যে যাপনচিত্র গড়ে তোলা হয়, কয়েক মুহূর্তের তাণ্ডবে তা ভেঙে চুরমার। প্রাকৃতিক বিপর্যয় এই কারণেই আতঙ্কের। তা বিত্তশালীদের যত না আঘাত করে, তার চেয়ে ঢের বেশি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেয় বিত্তহীনদের।
এর পরিপ্রেক্ষিতেই বোঝা যায় পরিবেশ রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা, যেখানে বিশ্ব উষ্ণায়ন মোকাবিলায় উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যের পার্থক্যটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রেমালের দাপটে শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের উপকূলভূমি নয়, বাংলাদেশের খুলনা, বরিশাল, সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম, ভোলার, পটুয়াখালিরও বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ঝড়, জলোচ্ছ্বাসে ভেঙেছে দেড় লক্ষ বাড়ি, মৃত অন্তত ১০। সামুদ্রিক ঝড়কে আটকে দেওয়া যায় না, কিন্তু তার ক্ষতির পরিমাণ হ্রাস করা যেতে পারে তৃতীয় বিশ্বের ঝড়প্রবণ এলাকাগুলির পরিকাঠামোগত উন্নতি ঘটিয়ে। এ ক্ষেত্রে আরও উদ্যোগী হওয়া উচিত উন্নত বিশ্বের। কারণ, সেই ‘ঐতিহাসিক দায়’। ভারত, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলি লড়ছে তাদের সীমিত সাধ্যের মধ্যে। সাইক্লোন সেন্টার নির্মাণ, পূর্বাভাসের ব্যবস্থা উন্নততর করা প্রভৃতির মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি রোখার আন্তরিক চেষ্টা চলছে। রেমাল আঘাত হানার পূর্বেই বাংলাদেশের প্রায় আট লক্ষ মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনা হয়েছিল। নয়তো প্রাণহানি অনেক গুণ বেশি হত। এই লড়াইয়ে উন্নত বিশ্বকে পাশে দাঁড়াতে হবে উন্নয়নশীল দেশগুলির, বিনা শর্তে। পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তোলার এর কোনও বিকল্প পথ নেই।