—প্রতীকী ছবি।
কার্বন বর্ডার অ্যাডজাস্টমেন্ট মেকানিজ়ম (চালু কথায় কার্বন ট্যাক্স বা কার্বন কর) যদি মুক্ত বাণিজ্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তা হলে কী কর্তব্য? দিল্লির বাণিজ্য মন্ত্রক এই প্রশ্নের যে উত্তর নির্ধারণ করেছে, তার সঙ্গে সহমত হওয়াই বাঞ্ছনীয়। সম্প্রতি ব্রিটেনের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির ক্ষেত্রে শর্ত আরোপ করেছে ভারত— ব্রিটেন যদি ইউরোপীয় ইউনিয়নের পথে হেঁটে কার্বন কর চালু করতে চায়, তা হলে তার আগে তারা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে বাধ্য থাকবে। ২০২৬ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নে চালু হচ্ছে কার্বন কর— সে অঞ্চলের কার্বন নীতির চেয়ে শিথিলতর কার্বন নীতি অনুসরণ করে, এমন কোনও দেশ থেকে ইস্পাত, সিমেন্ট, সারের মতো কিছু পণ্য আমদানি করা হলে তার উপরে বিশেষ কর আরোপ করা হবে। ভারতের মোট ইস্পাত রফতানির সিকি ভাগ যায় ইউরোপীয় ইউনিয়নে। ফলে, সেই অঞ্চলে ইস্পাত আমদানির উপরে ২৫-৩০ শতাংশ কর আরোপ করা হলে (বিশেষজ্ঞরা হিসাব কষে এমন হারেরই পূর্বাভাস দিয়েছেন) ভারতীয় ইস্পাত সেই বাজারে প্রতিযোগিতা করার ক্ষমতা হারাবে। বাণিজ্য মন্ত্রকের প্রধানতম দায়িত্ব হল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিসরে ভারতের স্বার্থরক্ষা করা। ফলে, কার্বন করের বিরোধিতা করা, এবং যে দেশ ভারতীয় পণ্যের ক্ষেত্রে এমন কর আরোপ করবে, প্রয়োজনে দেশের বাজারে সেই দেশের পণ্যের উপরে পাল্টা কর আরোপ করা যায় কি না, সেই পথের সন্ধান করা প্রয়োজন।
কার্বন করের অন্তর্নিহিত ধারণাটি অবশ্য গ্রহণযোগ্য, প্রয়োজনীয়ও বটে। বিশ্ব উষ্ণায়নের বিপদ যেখানে দাঁড়িয়েছে, তাতে যে খেয়ালখুশি মতো কার্বন নিঃসরণ করা চলে না, তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই। উন্নত বিশ্বের দেশগুলিকে এ কথা বিশেষ ভাবে স্মরণ করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণের পরিমাণে ভারত, এমনকি চিনের সঙ্গেও উন্নত দুনিয়ার কোনও তুলনাই চলে না। ফলে, কার্বন নিঃসরণে সতর্ক হওয়া সে দেশগুলির পক্ষে বিশেষ প্রয়োজন। যে-হেতু অর্থশাস্ত্রের পরিভাষায় কার্বন নিঃসরণ একটি নেগেটিভ এক্সটার্নালিটি বা নেতিবাচক অতিক্রিয়া, বাজার ব্যবস্থার মাধ্যমে নির্ধারিত দামের দ্বারা তাকে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় রাখা সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে কার্বন নিঃসরণের উপর বাইরে থেকে কর চাপিয়ে, এবং সেই করের থেকে অর্জিত অর্থ পরিবেশের ক্ষতিপূরণ বাবদ ব্যয় করে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করতেই হবে। রাষ্ট্রপুঞ্জের বিশ্ব উষ্ণায়ন সংক্রান্ত নীতি এ কথাই বলে। পরিবেশ ন্যায়ের মৌলিক শর্তটির সঙ্গেও এই অবস্থান সঙ্গতিপূর্ণ। কার্বন কর বাজার-অতিরিক্ত ব্যবস্থা হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয়।
প্রশ্নটি এই কর আরোপের ক্ষেত্র সংক্রান্ত। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বিশ্ব উষ্ণায়নের বিপদটি মূলত উন্নত দুনিয়ার পাপ— শিল্প বিপ্লব-পরবর্তী পর্যায়ে বিপুল কয়লা এবং পরবর্তী সময়ে পেট্রল-ডিজ়েল জ্বালিয়ে সেই দুনিয়া উন্নতিসাধন করেছিল। এই ঐতিহাসিক দায়টির কথা মাথায় রেখেই পরিবেশ-কূটনীতি রূপায়ণের প্রাথমিক স্তরে ‘অভিন্ন কিন্তু অসম’ দায়ের নীতি গৃহীত হয়েছিল। অর্থাৎ, বিশ্ব উষ্ণায়ন প্রতিরোধে সব দেশেরই দায় রয়েছে, কিন্তু সেই দায় সমান নয়— উন্নত দেশগুলির দায় উন্নয়নশীল দুনিয়ার চেয়ে বেশি। গত এক দশকে আন্তর্জাতিক পরিবেশ-কূটনীতি ক্রমেই এই অবস্থান থেকে বিচ্যুত হয়েছে। সেই বিচ্যুতিতে উন্নত দুনিয়ার লাভ, ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশের ক্ষতি। ফলে, ভারতকে লড়তে হবে কিয়োটো প্রোটোকলে বর্ণিত অসম দায়ের নীতির মূল ধর্মটুকু বজায় রাখার স্বার্থে। কার্বন করের বিরোধিতাও সেই জায়গা থেকে করাই বিধেয়। উন্নত দেশগুলিতে উৎপন্ন পণ্যের উপর যে হারে কার্বন কর আদায় করা বিধেয়, ভারতের মতো দেশের ক্ষেত্রে যে তা হতে পারে না, এ কথা বারে বারে মনে করিয়ে দিতে হবে।