—প্রতীকী ছবি।
দশ বছর অতিক্রান্ত। ২০১৩ সালের এই ডিসেম্বর মাসেই পাশ হয়েছিল কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা (প্রতিরোধ, নিবারণ ও অভিযোগ নিষ্পত্তি) সংক্রান্ত আইন, যা ‘পশ’ আইন নামে অধিকতর পরিচিত। আইন অনুযায়ী, কোনও সংস্থায় দশ জনের বেশি কর্মী থাকলেই সেখানে যৌন হেনস্থা প্রতিরোধের অভ্যন্তরীণ কমিটি তৈরি করতে হবে। এবং যে কোনও নারীকর্মী— স্থায়ী, অস্থায়ী, ঠিকাকর্মী, শিক্ষানবিশ— সকলেই আইনি সুরক্ষা পাবেন। কিন্তু বাস্তবজীবনে এই আইনের প্রয়োগ কতটুকু? সংগঠিত, অসংগঠিত উভয় ক্ষেত্রের নারীকর্মীরা কি আদৌ এই আইনের সুবিধা পাচ্ছেন? এ-হেন প্রশ্ন আরও জোরদার হয়েছিল কয়েক মাস পূর্বে ২০০৯ সালের দায়ের হওয়া একটি মামলার আবেদনের প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে। আদালতের বক্তব্য ছিল যে, আইনটির প্রয়োগে গুরুতর ফাঁক থেকে যাচ্ছে। সম্প্রতি লিঙ্গভিত্তিক হিংসার বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি প্রসঙ্গে কলকাতায় আয়োজিত এক আলোচনাসভায় আবার উঠে এল ‘পশ’ বিষয়ে সচেতনতার অভাবের দিকটি। জানা গেল, ভারতের কর্মরত মহিলাদের মধ্যে যে বিপুল সংখ্যক অসংগঠিত ক্ষেত্রে নিয়োজিত, তাঁদের সিংহভাগই এই আইন বিষয়ে প্রায় কিছুই জানেন না। চিত্রটি খুব উজ্জ্বল নয় সংগঠিত ক্ষেত্রেও। অভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটি (আইসিসি) থাকা সত্ত্বেও অনেক ক্ষেত্রেই তদন্ত প্রক্রিয়ায় গলদ থেকে যায়, যথাযথ আইন মেনে কমিটি গড়ার ক্ষেত্রেও ফাঁক থেকে যায়। অধরাই থাকে অভিযোগের নিষ্পত্তির বিষয়টি।
অথচ, কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের যৌন হেনস্থা প্রতিরোধের প্রচেষ্টাটি দীর্ঘ দিনের। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে রাজস্থানে ধর্ষিত, নির্যাতিত ভঁওয়রী দেবীর দীর্ঘ আইনি লড়াই ১৯৯৭ সালে জন্ম দিয়েছিল এক ঐতিহাসিক নির্দেশিকার— বিশাখা গাইডলাইনস। কিন্তু শিক্ষা-সহ বহু ক্ষেত্রে তা কার্যকর করার বিষয়ে চরম অনীহা দেখা দেয়। ২০১২ সালে এক জনস্বার্থ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট রাজ্য সরকারগুলিকে কঠোর ভাবে এই গাইডলাইন কার্যকর করার নির্দেশ দেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ‘পশ’-এর সৃষ্টি। তাতেও পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে আইসিসি বা ‘ক্যাশ’-এর উপস্থিতি সত্ত্বেও নিগৃহীতাদের এক বড় অংশ অপমানের কথা গোপন রাখেন বিবিধ কারণে। অন্যত্রও সামাজিক সম্মানহানি এবং হেনস্থার বিষয়টি মেয়েদের সরব হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। চটকলগুলিতে যৌন হয়রানি মেনে নেওয়াই মেয়েদের কাজ পাওয়ার শর্ত হিসাবে প্রতিষ্ঠিত।
অবস্থা সঙ্গিনতর অসংগঠিত ক্ষেত্রে। গৃহপরিচারিকা, দিনমজুর, খেতমজুর মেয়েদের উপর হয়রানির অভিযোগ জানানোর জন্য প্রতি জেলায় প্রশাসনিক উদ্যোগে লোকাল কমিটি তৈরি হওয়ার কথা। সর্বত্র সেই কমিটিগুলির অস্তিত্ব কোথায়? সচেতনতার প্রয়াসও চোখে পড়ে না। সর্বোপরি, এই আইন তৈরির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করা। সুতরাং, কর্মক্ষেত্রে শুধুমাত্র মেয়েদের নয়, পুরুষদের সমস্যার কথাও উঠে আসা প্রয়োজন। এই সুরক্ষাকবচের আওতার পুরুষদেরও আনা যায় কি না, অবশ্যই ভাবতে হবে প্রতিষ্ঠানগুলিকে। সমস্ত কর্মীর জন্য সুরক্ষিত পরিবেশ নির্মাণের দায়িত্ব নিয়োগকর্তার। আইন আছে, তার যথাযথ প্রয়োগ বাধ্যতামূলক।