Kolkata

কল্লোলিনী কাহিনি

আঠারো শতকের ব্রিটিশ  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মীদের ডায়েরি, চিঠিপত্র থেকে পরিষ্কার যে, বর্ষা নামলে তখন শহরের বুকে প্রতি দিন নৌকাডুবি হত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৪:২৮
Share:

বর্ষা আসে, কলকাতা ভাসে।

এই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। বর্ষা আসে, কলকাতা ভাসে। শোনা যায় কলকাতা অনেক পাল্টেছে, এখন তার অনেক নতুন বন্দোবস্ত। কিন্তু সব বন্দোবস্তকে হার মানিয়ে কলকাতার রাস্তা প্রতি বছর নিয়ম করে কল্লোলিনী হয়, তিলোত্তমা যদি বা না-ই হতে পারে। এই মহানগরের এটাই বৈশিষ্ট্য বলে মেনে নিতে হবে নগরবাসীকে। বুঝে নিতে হবে শহরের ভূগোল, আর তার সঙ্গে ইতিহাসের প্যাঁচ থেকে মোটেই উদ্ধার নেই। ইতিহাসে তো পড়াই গেছে যে কলকাতা শহরের গোড়াপত্তনের সঙ্গেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে তার জলসম্পর্ক। ক্রিক রো কিংবা আদিগঙ্গা কেবল নতুন-পুরনো মানচিত্রে লুকিয়ে থাকা কয়েকটি নাম নয়, কলকাতা শহর প্রকৃতই এক জলজ উদ্ধার। হুগলির ইংরেজ কুঠিতে মোগল বাদশাহের অনুচররা ঝামেলা পাকালে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী জোব চার্নক, আর তার পর খানিক বাধ্য হয়েই নিকটবর্তী সুতানুটি-কলকাতা স্থানটি পছন্দ করেন পরবর্তী আশ্রয় হিসাবে। বাস্তবিক, গঙ্গার তীরে জাহাজ ভিড়িয়ে এই জনপদ তৈরি করার কথা কেন মনে হয়েছিল ইংরেজ সাহেবের, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে প্রথম থেকেই যে নিচু জলাজমি আর বালিজমি দিয়েই তৈরি কলকাতার ভিত, সেটা একশো ভাগ নিশ্চিত ছিলেন বিলিতি সাহেবরা।

Advertisement

সেটা তাঁরা ভালই জানতেন, কেননা আঠারো শতকের ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মীদের ডায়েরি, চিঠিপত্র থেকেই পরিষ্কার যে, বর্ষা নামলে তখন শহরের বুকে প্রতি দিন নিয়মিত নৌকাডুবি হত। ফুলে ওঠা গঙ্গার জলতল তীর ছাপিয়ে ভাসিয়ে দিত দুই তীর, আর ঘরে ঘরে খিল দিয়ে ভয়ে কাঁপতেন সাহেব ও ‘নেটিভ’রা। ১৭৩৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরে এমনই একটি বর্ষারাতের বর্ণনা দিয়েছেন সুপ্রিম কাউন্সিলের সদস্য স্যর ফ্রান্সিস রাসেল— যা আমরা পড়েছি কলকাতা-ইতিহাস রচনাকার শ্রীপান্থ’র সৌজন্যে। রাসেলের সেই বয়ানেই জানা যায়, সে নাকি কলকাতার জীবনের এক ভয়ঙ্করতম দুর্যোগের রাত। প্রবল ঝড়, বৃষ্টি, এমনকি ভূমিকম্পের চোটে রাত্রিব্যাপী ধ্বংসলীলা চলে শহরে, আর পর দিন সকালবেলা উঠে সকলে দেখেন রাস্তায় রাস্তায় বহমান স্রোতোধারা, তার মধ্যে ভাসছে হাজার হাজার শবদেহ। গবাদি পশুর শবও আছে তার মধ্যে। পাঁচ টনের দু’খানি জাহাজ নাকি ছিটকে এসে পড়েছিল গঙ্গা থেকে, চল্লিশ ফুট বেড়ে গিয়েছিল হুগলি নদীর জল। নিকাশির সমস্যাও ছিল বিপুল— বিশেষ করে ‘নেটিভ’ কলকাতায়। স্বাভাবিক ভাবেই নিয়ম করে এই জলমগ্ন শহর দেখত আমাশা, কলেরা ও ম্যালেরিয়ার মতো ভীতিপ্রদ অসুখ। সাহেবদের কাছে হয়তো এই জন্যই হুগলি নদীর একটা আলাদা নাম দরকার হয়ে পড়েছিল গঙ্গা-ভাগীরথী ছাপিয়ে, যতই মোহনার দিকে যাওয়া, ততই ভয়াল নদীর রূপ ও চরিত্র। সে কালে কয়েক হাজার নৌকা আর জাহাজ চলাচল করত এই জলজ বসতি দিয়ে, বর্ষা হলেই নিয়ম করে তাদের কতকগুলি ডুবত। আর তাই জন্যই আঠারো শতকের অধিকাংশ মানচিত্রে মৌলালি-তালতলা অঞ্চলটির নাম— ডিঙাভাঙা। এর পাশ দিয়েই চলে গিয়েছে যে ক্রিক রো, তা যে ছিল আমাদেরই ছোট নদী, সে আর বলে দিতে হয় না। গঙ্গা থেকে সেই সরু জলপথ বেরিয়ে পুব দিকে এসে পড়ত বিস্তীর্ণ লবণহ্রদ এলাকায়— যেখানে এখন ঝাঁ-চকচকে সেজে উঠেছে নতুন উপনগর। এটুকু জানলে ইতিহাস-অনভিজ্ঞরাও হয়তো বুঝতে পারেন কেন লবণহ্রদ যখন সল্টলেক হয়, কলকাতার জলমগ্নতা কমার বদলে কেবল বেড়েই যেতে পারে।

আসল কথা, কলকাতা একা নয়, বহু ঔপনিবেশিক এবং উপনিবেশ-উত্তর শহরই গড়ে উঠেছে তার ভৌগোলিক চরিত্রের সঙ্গে সমতা না রেখে। সুতরাং ভূগোলের প্রতিক্রিয়া এড়াতেও তারা অসমর্থ। কেন বেঙ্গালুরু এমন অসহায় ভাবে জলের তলায় ডুবে যায়, তার কারণও কি শহর নির্মাণের অন্যমনস্কতা নয়? এ কালের জন্য তবে একটিই বার্তা পড়ে থাকে। পুরনো ভুল শোধরানোর কাজ সহজ নয়, তবু চেষ্টা করতেই হবে সংশোধনের। না হলে উন্নয়নের শত চাকচিক্যও জলপ্রতাপ কমাতে পারবে না। নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্যকে বাহ্যিক সৌন্দর্যের উপর স্থান দেওয়ার কথা বললে আধুনিক নাগরিকের গোসা হতে পারে, কিন্তু সন্ততিদের কথা ভেবেই ঠিক করতে হবে কর্তব্যের পৌর্বাপর্য। আজকের কলকাতা-শাসকদের হালচাল দেখে অবশ্য মনে হয় না, এই সব বিষয় নিয়ে তাঁরা আদৌ দুর্ভাবিত।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement