Sandeshkhali Incident

নির্যাতনের রকমফের

সংবাদমাধ্যমের সামনে সন্দেশখালির মেয়েরা জীবিকার ক্ষেত্রে ও সামাজিক জীবনে অরাজকতা, বাহুবলী নেতার সামনে পুলিশ-প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার এক সার্বিক ছবিই তুলে ধরেছেন বার বার।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৬ মার্চ ২০২৪ ০৭:৫৩
Share:

— ফাইল চিত্র।

বাহুবলী নেতাদের নির্যাতনের প্রতিবাদ করে, আইনের শাসন দাবি তুলে, সন্দেশখালির মহিলারা হয়ে উঠেছেন রাজ্যের প্রান্তিক মানুষের মুখ। গত মাস দুয়েক তাঁরাই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির কেন্দ্রে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে শুরু করে নানা দলের বিরোধী নেতারা সন্দেশখালির নির্যাতিতা মেয়েদের প্রসঙ্গ নিয়ে এসেছেন নির্বাচনী প্রচারে। আক্ষেপ, হাতুড়ির কাছে যেমন দুনিয়ার সব বস্তুই পেরেক বলে মনে হয়, তেমনই রাজনৈতিক নেতাদের কাছেও যে কোনও বিপন্ন মানুষ, যে কোনও মর্মান্তিক ঘটনা, কেবলমাত্র বিরোধীকে আক্রমণের অস্ত্র বলে ঠাহর হতে থাকে। অতএব মোদী ‘সন্দেশখালি’ বললেই মমতা বলছেন ‘হাথরস,’ মোদী পশ্চিমবঙ্গে নারীশক্তির উপর অত্যাচারের নিন্দা করলে উত্তরে মমতা মণিপুরের জাতিদাঙ্গায় নারী-নিগ্রহের দিকে আঙুল তুলছেন। মোদী গোটা পশ্চিমবঙ্গে ‘সন্দেশখালি ঝড়’ তুলতে বললে মমতা দাবি করছেন, পশ্চিমবঙ্গই মেয়েদের জন্য সব থেকে নিরাপদ রাজ্য। মোট কথা, বিষয়টা দলীয় রাজনীতির পরিচিত চাপান-উতোরের অতিপরিচিত ছাঁদে পড়ে গিয়েছে। ওই নির্যাতিত মেয়েরা কোন দলের পক্ষে, তা নিয়ে কদর্য টানাটানিও শুরু হয়েছে— তৃণমূল ও বিজেপি, দু’দলই ওই মেয়েদের দলীয় সভায় নিয়ে আসার চেষ্টা করে চলছে ক্রমাগত। নেতারা এক বারও ভেবে দেখেননি, এ ভাবে মেয়েদের প্রচার মঞ্চে তোলার চেষ্টা কার্যত দুর্বৃত্তদের নির্যাতনের উল্টো পিঠ নয় কি? কেউ শাসক দলের বিরুদ্ধে কথা বলানোর চেষ্টা করছেন, কেউ বা শাসকের প্রতি আনুগত্য ও আস্থার বয়ান বসাচ্ছেন তাঁদের মুখে। শেখ শাহজাহান ও তাঁর দলবল এই মেয়েদের উপর চাপ সৃষ্টি করে কাজে লাগাতে চেয়েছিল। বড় নেতারাও কি তা-ই করছেন না?

Advertisement

অথচ, সংবাদমাধ্যমের সামনে সন্দেশখালির মেয়েরা জীবিকার ক্ষেত্রে ও সামাজিক জীবনে অরাজকতা, বাহুবলী নেতার সামনে পুলিশ-প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার এক সার্বিক ছবিই তুলে ধরেছেন বার বার। তাঁদের কথার মর্যাদা দিলে তৎপর হওয়ার কথা ছিল সরকারের। বিভিন্ন বিভাগ থেকে প্রশাসনিক তদন্ত করানো, এবং গাফিলতি প্রমাণ হলে পুলিশ-প্রশাসনের আধিকারিকদের শাস্তি দেওয়া, এগুলোই প্রত্যাশিত ছিল। রাজনৈতিক দলের ভিতরেও শৃঙ্খলাভঙ্গের অনুসন্ধান হওয়া দরকার ছিল। কার্যক্ষেত্রে তা হয়নি। বরং মুখ্যমন্ত্রী তাঁর পরিচিত ভঙ্গিতে বিষয়টিকে হয় উড়িয়ে দিলেন, নইলে লঘু করলেন। বিধানসভার বাজেট অধিবেশনে তিনি বলেছিলেন, শেখ শাহজাহানকে ‘টার্গেট’ বা লক্ষ্য করে ইডি ঢুকেছে। আন্দোলনকারীদের ‘বহিরাগত’ বলেছেন, আরএসএস-এর উপরে তিনি এলাকা অশান্ত করার, সংখ্যালঘু ও জনজাতিদের মধ্যে সংঘাত বাধানোর চেষ্টার দায় চাপিয়েছেন। এমন ভাবেই কামদুনির গণধর্ষণের ঘটনার পরে এলাকার প্রতিবাদী মেয়েদের তিনি ‘মাওবাদী’ আখ্যা দিয়েছিলেন। পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ কাণ্ডের সত্যতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিল তাঁর দল। তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষও একটি সংবাদ চ্যানেলের আলোচনায় উপস্থিত নির্যাতিতারা ‘সাজানো’ কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন।

এতে এক দিকে যেমন অভিযোগকারিণীদের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ পায়, অপর দিকে তেমনই প্রকৃত ঘটনাকে ধোঁয়াশার মধ্যে রেখে দেওয়া যায়। দুটোই উদ্বেগজনক। উদ্বেগের বিষয় আরও আছে। অবৈধ ভাবে জমি দখল, জোর করে বেগার খাটানো, পরিবারের পুরুষদের মারধর, এমন অপরাধের জন্য সন্দেশখালির মেয়েরা দায়ী করেছেন শাহজাহানকে। বিরোধী দলগুলি কিন্তু সেই সব অভিযোগ ফেলে কেবল ধর্ষণের অভিযোগকেই বড় করে তুলে ধরছে। ধর্ষণ এক জঘন্য অপরাধ, তা নিয়ে প্রশাসনকে সদা সক্রিয় থাকতে হবে। তা বলে ধরে নেওয়া চলে না যে, নারীর ‘সম্মান’ তাঁর ভূসম্পত্তি বা শ্রমে নেই, রয়েছে কেবল প্রজননের অঙ্গে। দেহের উপর নির্যাতনকেই ‘নারী-নির্যাতন’ বলে ধরা, এই নিপাট পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতির থেকে বেরোনোর আশা আছে কি?

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement