—ফাইল চিত্র।
কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীদের আজ অর্ধদিবস ছুটি ঘোষণার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক ভাবেই অযোধ্যায় রামমন্দির উদ্বোধনের অনুষ্ঠানটিতে সরকারি সংযোগ ঘোষিত হয়েছে। এই ঘোষণার আগেও সংযোগের ব্যাপ্তি ও গভীরতা নিয়ে কারও কোনও সংশয় ছিল না, কিন্তু রাষ্ট্রচালনায় এমন একটি সিদ্ধান্তের তাৎপর্য বিস্তর, কারণ এতদ্দ্বারা এ বিষয়ে সমস্ত আবরণ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এই ঘোষণার কারণ হিসাবে সামাজিক আবেগের যে তত্ত্বটি খাড়া করা হয়েছে, তার যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। আজকের ভারতে আবেগে মিলায় বস্তু। কিন্তু মন্দিরময় দেশে আরও একটি মন্দিরের আবির্ভাব নিয়ে আবেগের প্রকৃত মাত্রা কতখানি, সেই প্রশ্ন গৌণ। মুখ্য প্রশ্ন হল, তার উদ্যাপনে রাষ্ট্র এমন বিপুল ভূমিকা গ্রহণ করে কোন যুক্তিতে? সংবিধানে আজও কথিত আছে যে, ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। সেই ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ নিশ্চয়ই নানা রকম হতে পারে। কিন্তু সমস্ত ধর্ম থেকে নিজেকে স্বতন্ত্র রাখার ‘বিদেশি’ ধারণার বদলে সমস্ত ধর্মের প্রতি সমভাব পোষণের যে ‘স্বদেশি’ সংজ্ঞা ভারতে স্বীকৃতি পেয়েছিল, তাকে অনুসরণ করলেও রামমন্দির কাহিনিতে সরকার তথা শাসক শিবিরের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। সমস্ত ধর্মের দেবালয় নির্মাণে বা আচার অনুষ্ঠানে শাসকদের এমন আগ্রহ ও তৎপরতার এক শতাংশও দেখা যায়নি, দেখার প্রত্যাশাও কেউ করেন না। স্পষ্টতই, বর্তমান রাষ্ট্রনায়কদের কাছে ধর্মনিরপেক্ষতা একটি শব্দমাত্র, যা সংবিধানে থাকতেও পারে, না-ও থাকতে পারে, কী বা তাতে এল গেল?
স্পষ্টতই, বর্তমান ভারত তার পূর্বাশ্রম থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে। এখনও সেই আশ্রমের পরিচিত মন্ত্রগুলি সকলেই বিস্মৃত হননি। অনেকের মুখেই এখনও শোনা যাচ্ছে: ধর্মের সঙ্গে রাজনীতিকে মেশানো উচিত নয়; রাজনীতিতে ধর্মের কোনও স্থান নেই; ধর্ম যার যার নিজের ব্যাপার, তাকে রাজনীতির হাতিয়ার করা অন্যায়। কিছু কাল আগেও ধর্মনিরপেক্ষতা অন্তত আদর্শ হিসাবে জনারণ্যে গুরুত্ব পেত, বাস্তব রাজনীতি প্রায়শই সেই আদর্শ লঙ্ঘন করছে বলে সমালোচিত হত। কিন্তু দেশের শাসকরা হিন্দুত্ববাদী প্রকল্পের যে সর্বগ্রাসী অভিযান চালাচ্ছেন, তার সামনে এই কথাগুলি উত্তরোত্তর নিছক কল্পনাসর্বস্ব উচ্চারণের মতো শোনাচ্ছে না কি? ইতস্তত কোনও কোনও রাজনীতিক যখন বলেন, তিনি আপন সদাচারের মধ্য দিয়েই যথার্থ ধর্মাচরণ করেন, ধর্মের নামে আবেগের রাজনীতি করেন না, তখন শ্রোতাদের মনে হতেই পারে— ওঁরা এই পৃথিবীর কেউ নন ইদানীং বেড়াতে এসেছেন।
তবে কি মেনে নিতে হবে, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ধারণাটিই ভারতে অচল হয়ে গিয়েছে? দেশের মানুষ একটি ধর্মাশ্রিত রাষ্ট্রকেই ‘নতুন ভারত’ অন্তরে অন্তরে বরণ করে নিয়েছেন? যাঁরা এখনও সেই পথে হাঁটছেন না, তাঁরা ক্রমে দলে ভিড়ে যাবেন, বা ব্যতিক্রমের নজির হয়ে নিয়মকেই প্রমাণ করবেন? হিন্দুরাষ্ট্রের উপাসকরা প্রবল বিক্রমে তেমনটাই প্রচার করে চলেছেন। তাঁদের মতে নরেন্দ্র মোদীর মহিমায় নতুন ভারতের উদয় হয়েছে, রামমন্দির তার মূর্ত প্রতীক। নির্বাচনী পরীক্ষায় সাফল্যের নজির দেখিয়ে তাঁরা এই প্রচারের সত্যতা প্রতিষ্ঠায় তৎপর। নির্বাচনী সাফল্য অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু একটি সত্যকে এই প্রচারকরা সন্তর্পণে এড়িয়ে যান। সেটি এই যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আজ অবধি কখনওই হিন্দুত্ববাদী প্রকল্পের পক্ষে ভোট দেননি, না সর্বভারতীয় নির্বাচনে, না অধিকাংশ রাজ্যের নির্বাচনে। এ দেশের সংসদীয় ব্যবস্থায় আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য অধিকাংশ নাগরিকের ভোট পাওয়া জরুরি নয়, কিন্তু ‘দেশ পাল্টে গিয়েছে’ বলার জন্য সেটাই প্রাথমিক শর্ত। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ— আজও— এই ‘নতুন ভারত’কে স্বীকার করেননি। এই সত্য জানা আছে বলেই কি সরকারি কর্মীদের ছুটি দিয়ে বাড়তি আবেগ উৎপাদন করার প্রয়োজন হয়?