—প্রতীকী ছবি।
নোট বাতিলের প্রক্রিয়াটিকে তিনি অবৈধ বলে মনে করেন, জানালেন সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি বি ভি নাগরত্ন। গত বছর এই মামলায় তিনি বিরুদ্ধবাদী রায় দিয়েছিলেন, সে কথা জানিয়ে তার কারণগুলিও ব্যাখ্যা করলেন বিচারপতি নাগরত্ন। নোট বাতিলের ভয়াবহ ঘটনাটিকে ফের আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসার জন্য তিনি ধন্যবাদার্হ। ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর তারিখটির তাৎপর্যও যদি ভারতীয় নাগরিকরা ভুলে যান, তা গণতন্ত্রের পক্ষে দুর্ভাগ্যজনক হবে। তার কারণটি শুধু এই নয় যে, নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত ভয়ঙ্কর রকম ভুল ছিল। দেশশাসনের প্রক্রিয়ায় ভুল হতে পারে, মারাত্মক রকম ভুলও হতে পারে। কিন্তু, কোন পথে সরকার বা রাষ্ট্রযন্ত্র সেই ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল, আসল প্রশ্ন সেখানে। বিচারপতি নাগরত্ন মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যাবতীয় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সচেতন ভাবে অবহেলা করা হয়েছিল। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা অথবা নাগরিক সমাজের মত গ্রহণের কথা দূরে থাকুক, বিচারপতি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, হয়তো তৎকালীন অর্থমন্ত্রীও এই সিদ্ধান্তটির বিষয়ে সম্যক ভাবে অবহিত ছিলেন না। ভারতীয় অর্থব্যবস্থার পরিচালনায় সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিচারপতি নাগরত্ন। রাতারাতি এমন গুরুতর একটি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে তাকে কার্যকর করে ফেলার এই তাড়া কেন, সে প্রশ্নটি প্রত্যেক ভারতীয়ের করা প্রয়োজন।
মনে রাখতে হবে, এই দীর্ঘ সময়েও কেন্দ্রীয় সরকার প্রমাণ করতে পারেনি যে, এই সিদ্ধান্তটি যে কারণে গৃহীত হয়েছিল, সেই উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে। বস্তুত, এমন অর্থনীতি-মেধ যজ্ঞের কারণটি কী ছিল, এত দিনে সে কথাও স্পষ্ট হয়নি। অনেকেরই স্মরণে থাকবে, সে সময় প্রায় দিনই অর্থমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলন করে বিবিধ উদ্দেশ্যের কথা বলতেন। তার কোনওটাই সফল হয়েছে কি? বিচারপতি নাগরত্ন প্রশ্ন করেছেন, যদি বাজারে চালু থাকা ১০০০ ও ৫০০ টাকার নোটের প্রায় সবই রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কে ফিরে আসে, তা হলে কালো টাকা আর নষ্ট কোথায় হল? নগদে লেনদেনের পরিমাণও যে কমেনি, পরিসংখ্যানে তা-ও স্পষ্ট। তা হলে, এত মানুষকে এত দুর্ভোগের মুখে ফেলা হল কেন? বিচারপতি নাগরত্ন শ্রমজীবী মানুষের প্রবল সমস্যার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। মনে রাখা ভাল, সিয়াচেনে প্রহরারত যে জওয়ানদের দোহাই দেওয়া সেই সময় শাসকপক্ষের রাজনৈতিক বয়ান হয়ে দাঁড়িয়েছিল, নোট বাতিলের তাণ্ডব তাঁদের বা তাঁদের পরিবারকেও রেয়াত করেনি। ভারতীয় অর্থব্যবস্থার ইতিহাসে নোট বাতিল তুঘলকি শাসনপদ্ধতির উদাহরণ হিসাবে গণ্য হতে পারে।
এত দিন বাদে নোট বাতিলের প্রসঙ্গ তুলে কী লাভ? প্রথমত, গণতন্ত্র ও সুশাসনের যাবতীয় শর্ত উল্লঙ্ঘন করার পরও যদি সরকারপক্ষ বিনা প্রশ্নে নিষ্কৃতি পায়, তা হলে গণতন্ত্রের বিপুল শক্তিক্ষয় ঘটে। ক্রমে শাসককে প্রশ্ন করার অধিকারটি মানুষের হাতছাড়া হতে থাকে। সেই প্রশ্নহীন আনুগত্যের অভিমুখে যাত্রাপথটি কেমন, ভারত ইতিমধ্যেই তার যথেষ্ট আভাস পেয়েছে। দ্বিতীয়ত, নোট বাতিল ভারতীয় অর্থব্যবস্থার যে ক্ষতি করেছে, তার ঘা এখনও শুকায়নি। দেশের বিপুল অসংগঠিত ক্ষেত্রের কোমর ভেঙে দিয়েছিল এই হঠকারী সিদ্ধান্তটি। তার পরবর্তী বিভিন্ন আর্থিক সূচক জানাচ্ছে, কী ভাবে সেই ধাক্কায় দেশের সিংহভাগ মানুষ আর্থিক ভাবে বিপন্নতর হয়েছেন। ভারতে বর্তমানে যে বিপুল আর্থিক অসাম্য রয়েছে, তার পিছনে নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের ভূমিকা কম নয় বলেই অনুমান করা চলে। অতএব, উত্তর দেওয়ার দায় সরকারের ফুরোয়নি। ২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশের প্রবল তাৎপর্যপূর্ণ বিধানসভা নির্বাচনের আগেই কেন নোট বাতিল করতে হল, এই প্রশ্নেরও সম্যক জবাব চাই বইকি।