Manipur Violence

আসল সত্য

কেন গিল্ডের রিপোর্ট মণিপুরে পুলিশ তথা শাসকের চক্ষুশূল হল, তা খতিয়ে দেখলে বেরিয়ে পড়বে সেই সত্য— বিজেপি-শাসিত মণিপুর তো বটেই, কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষেও যা চূড়ান্ত অস্বস্তির।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৬:৫০
Share:

মণিপুরের অশান্ত পরিস্থিতি। —ফাইল চিত্র।

একক সংবাদপত্র-প্রতিষ্ঠান বা একাকী সাংবাদিক তো বটেই, সাংবাদিকদের সর্বভারতীয় সংগঠনেরও যে শাসকের অসূয়ার হাত থেকে নিস্তার নেই, এটাই আজকের ভারতে বাস্তবসত্য। এডিটরস গিল্ড অব ইন্ডিয়া (ইজিআই) গত ২ সেপ্টেম্বর মণিপুর নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে, তার পর পরই গিল্ডের সভাপতি ও আরও তিন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অন্তত দু’টি এফআইআর করেছে মণিপুর পুলিশ। ভারতীয় দণ্ডবিধির অনেকগুলি ধারা প্রয়োগ করে অভিযোগ এনেছে যে গিল্ডের রিপোর্ট অসত্য, মিথ্যা— মণিপুরে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে শত্রুতা ছড়ানোর কৌশল! এই সাংবাদিকেরাও হয়তো এত ক্ষণে গ্রেফতার হয়ে জেলের ভিতরে থাকতেন, যদি না শীর্ষ আদালত হস্তক্ষেপ করত। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ গত ৬ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী আদেশ দিয়েছে, পরবর্তী দিন আদালত এই ঘটনা বিস্তারিত না শোনা পর্যন্ত মণিপুুর পুলিশ ওই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কোনও রকম দমনমূলক পদক্ষেপ করতে পারবে না।

Advertisement

কেন গিল্ডের রিপোর্ট মণিপুরে পুলিশ তথা শাসকের চক্ষুশূল হল, তা খতিয়ে দেখলে বেরিয়ে পড়বে সেই সত্য— বিজেপি-শাসিত মণিপুর তো বটেই, কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষেও যা চূড়ান্ত অস্বস্তির। জনজাতি-সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃত তথ্য অনুসন্ধানে এডিটরস গিল্ড মণিপুরে এক সাংবাদিক-দল পাঠিয়েছিল, হিংসার শিকার ও প্রত্যক্ষদর্শী বহু মানুষের সঙ্গে কথা বলে সাংবাদিকেরা এই রিপোর্ট তৈরি করেন। সেখানে বলা হয়েছে, প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এমন সিদ্ধান্তের যথেষ্ট অবকাশ আছে যে মেইতেই-কুকি জনজাতি সংঘর্ষে মণিপুরের স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা ছিল পক্ষপাতমূলক, ইম্ফলের সংবাদমাধ্যম সেখানে দেখা দেয় ‘মেইতেই সংবাদমাধ্যম’ রূপে। গিল্ডের কাছে এক লিখিত অভিযোগে ভারতীয় সেনাবাহিনীর থার্ড কোর হেডকোয়ার্টার্সও জানিয়েছিল, ইম্ফল তথা মণিপুরে সংবাদমাধ্যমের আচরণ শান্তি আনার বদলে বরং উস্কানি দিচ্ছে, তথ্য ও বাস্তবকে ভুল ভাবে উপস্থাপন করছে। বুঝতে ভুল হয় না, দিল্লিতে শাসক দল তথা কেন্দ্রীয় সরকারের ভজনা যেমন জাতীয় সংবাদমাধ্যমের প্রধানতম কাজ হয়ে উঠেছে, রাজ্য স্তরে তারই নিদর্শন দেখা গেল মণিপুরেও। এডিটরস গিল্ডের রিপোর্টে বিশদে উঠে এসেছে মণিপুরে সংবাদমাধ্যমের দ্বিধাবিভক্তি, ক্রমবর্ধমান হিংসার আবহে রাজ্য সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ায় ভুয়ো খবর বনাম প্রকৃত তথ্য যাচাইয়ের চ্যালেঞ্জ, জাতীয় সংবাদমাধ্যমে মণিপুর নিয়ে নাগাড়ে একপেশে ও বিভ্রান্তিকর খবর করার কথা।

এই সব কিছুকেই সংবাদমাধ্যমেরই ঘাড়ে, আগাগোড়া তারই ব্যর্থতার দায় বলে চাপানো যেত যখন, তার বদলে হঠাৎ মণিপুর সরকার ও পুলিশের এত এফআইআর-এর ঘনঘটা কেন? কারণ, মণিপুরের জনজাতি-হিংসার পূর্বাপর বিচার ও সংবাদমাধ্যমের আত্মসমীক্ষার মোড়কে যে ভাবে রাজ্য সরকারের অপদার্থতা এবং সেই সঙ্গে দিল্লির নিষ্ক্রিয়তার কথাও উঠে এসেছে, রাজ্য বা কেন্দ্র কারও পক্ষেই তা হজম করা কঠিন। এই রিপোর্ট স্বীকার করলে বীরেন সিংহের সরকারকে এই সত্যও কবুল করতে হয়— জনজাতি-পরিচয়, ধর্ম, আর্থ-সামাজিক অবস্থানের ঊর্ধ্বে উঠে সকল নাগরিক তথা সাধারণ মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যে সরকারের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য, সেই কর্তব্য পালনের পরীক্ষায় তারা দৃষ্টিকটু রকমের ব্যর্থ। আবার এই রিপোর্টের পরিণামে কেন্দ্রের শাসকদেরও ঢোঁক গেলা ছাড়া উপায় থাকে না, কেননা মণিপুর প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর নীরবতার জেরে বিরোধীরা সংসদে অনাস্থা প্রস্তাব আনার উপক্রম করেছেন, সেই আবহে এ রিপোর্ট স্বভাবতই বিরোধীদের হাতিয়ার হয়ে ওঠার ক্ষমতা রাখে। তার চেয়ে ঢের সহজ রিপোর্টকেই মিথ্যে বলে প্রচার, কিংবা ভয় দেখানোর চিরাচরিত পথ। তাতেও কি চিঁড়ে ভিজবে?

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement