—প্রতীকী ছবি।
পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক অধোগতি নিয়ে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর গভীর উদ্বেগকে স্বাগত জানানো জরুরি ছিল। কিন্তু জরুরি হলেও তা করা গেল না, কেননা অর্ধসত্য এবং তথ্যের মোচড়ে তিনি শেষ অবধি যা বললেন, তাতে রাজ্য বিষয়ে উদ্বেগের চেয়ে ঢের বেশি রয়েছে তাঁদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তৃণমূল কংগ্রেসকে কোণঠাসা করার চেষ্টা। কথার প্যাঁচে প্রকৃত সত্যটি হারিয়ে গেলে আপত্তি না তুলে উপায় নেই। নির্মলা আফসোস করে বলেছেন যে, ১৯৪৭ সালে দেশে শিল্পোৎপাদনে সর্বাগ্রগণ্য ছিল পশ্চিমবঙ্গ, সেই রাজ্য এখন তলানিতে এসে ঠেকেছে। অর্থমন্ত্রী যে কথাটি বলতে ভুলে গিয়েছেন, তা হল, দেশভাগের ফলে এক দিকে যেমন অবিভক্ত বঙ্গের সেই অগ্রসরতার অন্যতম কারণ পাটশিল্প বিপুল পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হল, অন্য দিকে তৎকালীন ভারতের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম প্রদেশটির ঘাড়ে চাপল জনসংখ্যার বিপুল বোঝা। ১৯৫১ থেকে ১৯৬১ সালের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল ৩২.৮%, এবং এই রাজ্যের জনঘনত্ব ছিল প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৩৯৯। এর তুল্য বোঝা আর কোনও প্রদেশকে বহন করতে হয়নি। অর্থমন্ত্রী বলতে ভুলে গিয়েছেন যে, পশ্চিমবঙ্গ শিল্পোন্নত রাজ্য, এই অজুহাতে প্রথম চারটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এই রাজ্যের জন্য বরাদ্দের পরিমাণ অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় অনেকখানি কম হয়েছিল। এবং, তিনি এ কথাও ভুলেছেন যে, মাসুল সমীকরণ নীতির কারণে প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ হওয়ার তুলনামূলক সুবিধাটিও পশ্চিমবঙ্গ হারায়। ঘটনা হল, পশ্চিমবঙ্গের প্রতি হওয়া এই কেন্দ্রীয় বঞ্চনাগুলির কোনওটিরই দায় তাঁর দলের নয়— বস্তুত, বিজেপির পূর্বসূরি রাজনৈতিক দলগুলি তখন রাজনৈতিক ভাবে এমনই অকিঞ্চিৎকর ছিল যে, কোনও নীতিতেই তাদের কোনও দায় বা কৃতিত্ব থাকার প্রশ্ন নেই। অনুমান করা চলে যে, নির্মলা সীতারামনের সেই ইতিহাসে আগ্রহ নেই— তিনি পশ্চিমবঙ্গের উদ্দেশে তির নিক্ষেপ করে বর্তমান রাজনীতিতে কিছু ‘ব্রাউনি পয়েন্ট’ অর্জন করতে চান। তবুও তাঁকে একটি বইয়ের কথা মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে— রণজিৎ রায়ের লেখা দি অ্যাগনি অব ওয়েস্ট বেঙ্গল: আ স্টাডি ইন ইউনিয়ন-স্টেট রিলেশন (১৯৭১)। বইটি ইন্টারনেটে সহজলভ্য— ডাউনলোড করে পাঠ করলে তাঁর চোখ খুলতে পারে।
অতীত ছেড়ে যদি বর্তমানের দিকে তাকানো যায়, তাতেও অর্থমন্ত্রী-বিবৃত দুর্দশার সন্ধান পাওয়া মুশকিল। রাজ্যের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ দেশের ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে। আর্থিক বৃদ্ধির হার সর্বভারতীয় গড়ের কাছাকাছি, কিছু কিছু সময়ে খানিক কম। রাজ্যের মোট উৎপাদনের ৭৫% শিল্প ও পরিষেবা ক্ষেত্র থেকে আসে। দারিদ্র দূরীকরণেও পশ্চিমবঙ্গ ভাল কাজ করেছে। গত দেড় দশকে রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে মাথাপিছু ভোগব্যয়ের বৃদ্ধির হার ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্বন্ধে একটি কথা বলা চলে— উৎপাদনের চেয়ে এই রাজ্যে সাম্প্রতিক অতীতে বণ্টন অধিকতর গুরুত্ব পেয়েছে। সে প্রসঙ্গে রাজ্যে সরকারের লক্ষ্মীর ভান্ডারের মতো বিভিন্ন নগদ হস্তান্তর প্রকল্পের কথা আসবে। শিল্পায়নকে বাদ রেখে পুনর্বণ্টনের নীতি কত দূর অবধি সফল হতে পারে, সে প্রশ্ন অনস্বীকার্য। কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গে কিছুই হচ্ছে না, এই কথাটি বলার মধ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অর্ধসত্যের ব্যবহার প্রকট। পশ্চিমবঙ্গের ঋণের বোঝা নিয়েও অর্থমন্ত্রী প্রশ্ন তুলেছেন। এই প্রথম নয়, গত দু’বছরে কেন্দ্রীয় সরকার বারে বারেই এই প্রসঙ্গ তুলেছে। পশ্চিমবঙ্গ নিঃসন্দেহে ঋণগ্রস্ত, কিন্তু তার চেয়েও বেশি ঋণগ্রস্ত বড় রাজ্য একাধিক রয়েছে; এবং রাজ্যের আয়ের অনুপাতে ঋণের বোঝা বলছে যে, তা পরিশোধ করা অসম্ভব নয়। ফলে, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর উদ্বেগটি অন্তত আংশিক ভাবে অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু, তাঁরা তো রাজনীতি করছেন। তার সঙ্গে সত্যের যোগ সতত ক্ষীণ।