—প্রতীকী ছবি।
গত বছর ছিল ৩৮ থেকে ৪০ হাজার কোটি, এ বছর নাকি তা বেড়ে হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ, ৮০ থেকে ৮৪ হাজার কোটি! দুর্গাপুজো ঘিরে অর্থনীতির এই আনুমানিক বিস্তারের কথা সম্প্রতি সগর্বে বললেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। সন্দেহ নেই যে, গত বছর কলকাতার দুর্গাপুজো ইউনেস্কোর আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সম্মান পাওয়ার পর এ বছর পুজো-উৎসব ঘিরে আবেগ ও অর্থনীতি দুইয়েরই বিস্ফার ছিল প্রত্যাশিত; পুজো উদ্যোক্তা ও বিজ্ঞাপনদাতা এই দুই তরফে এবং খুচরো বিপণি ও হোটেল-রেস্তরাঁর ব্যবসা মিলে যে বিপুল এক অর্থযজ্ঞ হবে, তার ইঙ্গিত মিলেছিল। মুখ্যমন্ত্রী সেই ইঙ্গিতটিই স্পষ্ট করেছেন। উদ্ধৃত করেছেন ব্রিটিশ কাউন্সিলের এক গবেষণা-প্রকল্পের প্রাথমিক হিসাব, এ বছরের পুজো-অর্থনীতি তাদের মতে প্রায় ৭২ হাজার কোটি টাকার, মুখ্যমন্ত্রীর বিশ্বাসে যা ৮০ থেকে ৮৪ হাজার কোটি ছোঁয়া অসম্ভব কিছু নয়।
বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপুজো অর্থনীতির মুখেও চওড়া হাসি ফোটালে তা নিশ্চয়ই খুব ভাল ব্যাপার। দুর্গাপুজো ঘিরে বিপুল বাণিজ্য, লেনদেন ও কর্মসংস্থান, এই সবই রাজ্যের অর্থনীতির জন্য জরুরি। সে জন্যই এই আর্থিক বিষয়গুলির ক্ষেত্রে বিশ্বাস অনুমান ইত্যাদির স্থান নেই, দরকার দুর্গাপুজো-অর্থনীতির প্রতিটি খাত ধরে ধরে তাদের যথাযথ হিসাব নেওয়া ও রাখা। এই হিসাব রাখা খুব কঠিন কাজ নয়, অসম্ভব তো নয়ই, কারণ দুর্গাপুজো-কেন্দ্রিক মূল খাতগুলি সরকারের জানা: বিজ্ঞাপন, মণ্ডপশিল্প, প্রতিমা, আলো, চারু-কারুকলা, উৎসব-সাহিত্য ও প্রকাশনা, খাদ্য-পানীয়, খুচরো বাণিজ্য। পুজো-উদ্যোক্তা ও বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে উপরের অধিকাংশ খাতেরই হিসাব থাকে, কারণ পরের বছরের পুজো বাজেটের সঙ্গে তা সরাসরি সংশ্লিষ্ট। রাস্তার পাশের ফুচকা-রোল-চাউমিন-নরম পানীয়’সহ খুচরো বা অসংগঠিত ক্ষেত্রের বাণিজ্যের পূর্ণাঙ্গ হিসাব পাওয়া সমস্যার, কিন্তু হোটেল-রেস্তরাঁগুলির হিসাব সুলভ— যদি প্রশাসন সেই মতো প্রয়াস করে। সবচেয়ে বড় কথা, পুজো-অর্থনীতি বিষয়ক যে সমীক্ষার কথা মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, তা আসলে ব্রিটিশ কাউন্সিল, আইআইটি খড়্গপুর ও লন্ডনের কুইন মেরি ইউনিভার্সিটির এক যৌথ কাজ যা শুরু হয়েছে ২০১৯-এই, এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আনুকূল্যেই। সেই সব তথ্য-উপাত্ত তো সরকারের হাতেই আছে!
শুধু দুর্গাপুজো-অর্থনীতির সুষ্ঠু ও পূর্ণাঙ্গ হিসাব রাখাই নয়, আরও একটি কাজ করা জরুরি— বিশ্বের জনপ্রিয়, ঐতিহ্যশালী উৎসবগুলির মতোই দুর্গাপুজোকেও তুলে ধরা। ইউনেস্কোর সম্মানে সে কাজ শুরু হয়েছে কিছুটা, পুজো-অর্থনীতিতে তারই ছায়া পড়েছে, কিন্তু দুর্গাপুজো ঘিরে সরকারের ব্যবস্থাপনায় এখনও রয়েছে বিস্তর ফাঁকফোকর, অব্যবস্থা, অসঙ্গতি। সরকারকে বুঝতে হবে পুজো মানে স্রেফ ক্লাবগুলিকে বছর বছর অর্থসাহায্য বাড়ানো নয়; দরকার পুজো-উদ্যোক্তা বিজ্ঞাপনদাতা শিল্পী কারিগর কর্মী বিক্রেতা ব্যবসায়ী উদ্যোগপতি সংস্কৃতি-ইতিহাসবিদ সকলকে একসূত্রে গেঁথে দুর্গাপুজোকে সারা পৃথিবীর প্রতীক্ষিত উৎসবগুলির অন্যতম করে তোলা। তা করতে গেলে শারদোৎসবকে করে তুলতে হবে নান্দনিক থেকে আর্থিক ব্যবস্থাপনারও চরম উৎকর্ষের নিদর্শন। ৮৪ হাজার কোটি টাকা ছেলেখেলার ব্যাপার নয়, রাজ্যের ভবিষ্যৎ স্বার্থেই তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত হওয়া দরকার।