সংসদ। —ফাইল চিত্র।
কেউ যদি প্রশ্ন করেন যে, ‘ব্যক্তি’ কাকে বলে, সংসদের দুই কক্ষে পাশ হওয়া ডিজিটাল ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা বিল থেকে তার একটি বিচিত্র সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব। সেই বিলে ‘পার্সন’ বা ব্যক্তির সংজ্ঞায় উল্লেখ রয়েছে ইন্ডিভিজুয়াল বা একক ব্যক্তি, হিন্দু অবিভক্ত পরিবার, কোনও কোম্পানি, কোনও বাণিজ্যিক সংস্থা, একাধিক ব্যক্তি দ্বারা গঠিত কোনও সংগঠন, এবং রাষ্ট্রের। ‘ব্যক্তি’-র সংজ্ঞার এ-হেন স্ফীতির তাৎপর্য নিহিত রয়েছে তথ্যের অধিকার আইনে। সেই আইনের ধারায় বলা আছে, ব্যক্তিগত তথ্য সংক্রান্ত কোনও তথ্য, যেটির সঙ্গে জনসাধারণের কার্যকলাপ বা জনস্বার্থের কোনও সম্পর্ক নেই বা যার ফলে কারও ব্যক্তিগত পরিসরে অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ করা হবে, তাকে এই আইনের আওতার বাইরে রাখা হবে। তবে যদি কর্তৃপক্ষ মনে করেন যে, জনস্বার্থে এই তথ্য প্রকাশের প্রয়োজন রয়েছে, তবেই সেই তথ্য জনসমক্ষে আনা সম্ভব। অর্থাৎ, ব্যক্তির সংজ্ঞা পাল্টানোর সঙ্গে সঙ্গে এমনকি রাষ্ট্র বিষয়ক তথ্য পাওয়া বা না-পাওয়াও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিবেচনার উপরে নির্ভরশীল হবে, তেমন আশঙ্কা প্রবল। সেই বিবেচনা বা নিয়ন্ত্রণের ফল কার পক্ষে অনুকূল হবে, বলে দেওয়ার দরকার পড়ে কি?
এক দিকে যদি সরকার, শাসনবিভাগ বা রাষ্ট্রকে জনগণের নজরদারির বাইরে নিয়ে আসা থাকে, অন্য দিকে রয়েছে জনগণের উপরে নজরদারি বৃদ্ধির আশঙ্কা। যদিও কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি, বিলটি ডিজিটাল দুনিয়ায় আমজনতার ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা ও গোপনীয়তা বজায় রাখবে। অথচ, এই আইন থেকে তাদের নিরাপত্তা, গোয়েন্দা এবং তদন্তকারী সংস্থাগুলিকে ছাড় দেওয়ার ক্ষমতা তারা নিজেদের হাতে রাখছে। বিল-এ এও বলা হয়েছে, সরকার দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা, নিরাপত্তা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে যে কোনও সরকারি সংস্থাকে জনগণের ব্যক্তিগত তথ্যে নজরদারি বা তাকে কাজে লাগানোর ক্ষমতা দিতে পারবে। প্রসঙ্গত, গত বছর নভেম্বরে বিলের একটি খসড়া সংসদে পেশ করার পর তাতে কিছু অদলবদল করে বর্তমানে সেটি সংসদে পুনরায় পেশ করা হয়। বিলের কিছু বিতর্কিত অংশ নিয়ে এমনিতেই বিভিন্ন মহলে ছিল উদ্বেগ। সেই সব উদ্বেগকে স্থায়ী রূপ দিয়েই পাশ হল বিলটি।
দু’টি আশঙ্কাই মূলগত ভাবে যুক্ত এই সরকারের গণতন্ত্রের প্রতি অশ্রদ্ধার চরিত্রলক্ষণে। রাষ্ট্র নিজের তথ্য নাগরিকের থেকে যথাসম্ভব আড়াল করতে চায়, কিন্তু নাগরিকের যাবতীয় তথ্য নিয়ে আসতে চায় নিজের নজরদারির আওতায়— অর্থাৎ, গণতন্ত্রের পরিসরে জবাবদিহি করার দায়টি স্বীকার করতে রাষ্ট্র রাজি নয়, কিন্তু নাগরিককে কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখতে উদ্গ্রীব। এক দিকে প্রশ্ন করার অবকাশ হ্রাস করা, এবং অন্য দিকে কেউ সেই দুঃসাহস দেখালে তাকে বিবিধ নাগপাশে আবদ্ধ করা, এ লক্ষণ একাধিপত্যকামী শাসকের। ভারত কোন পথে চলেছে, সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপেই তার নির্ভুল সঙ্কেত পাওয়া যায়। ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা বিলটি যত বার পাল্টেছে, তত বারই তার অবয়বে ফুটে উঠছে ঘুরপথে শাসনের ফাঁস কঠোরতর করার অপপ্রয়াস। এখানেই নাগরিক সমাজর দায়িত্ব। সরকার যদি জনস্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে নিজস্ব ক্ষুদ্র স্বার্থ রক্ষায় ব্যাকুল হয়, তবে সর্বদা সজাগ থাকাই কর্তব্য।