প্রতীকী ছবি।
আরম্ভ হইয়াছিল এক বৈশ্বিক স্বাস্থ্যসঙ্কট হিসাবে। বৎসরাধিক কাল পরে জানা গেল, কোভিড-১৯ সারা পৃথিবীতে গণতন্ত্রেরও সঙ্কট আনিয়াছে। ব্রিটিশ সংস্থা ‘ইকনমিক গ্রুপ’-এর গবেষণা ও বিশ্লেষণ বিভাগের রিপোর্ট জানাইল, ২০২০ সালটি গত পনেরো বৎসরে গণতন্ত্র সূচকে সর্বনিম্ন নম্বর পাইয়াছে। দেশে দেশে কোভিডকালীন জরুরি অবস্থা ঘোষণা ও পদক্ষেপের কারণে অপহৃত হইয়াছে মানবাধিকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতা। অতিমারিতে লকডাউন ও বিধিনিষেধ আরোপ ভিন্ন গত্যন্তর ছিল না, কিন্তু সেই সব নিয়ম গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করিয়াছে। তাহাতে এশিয়া আফ্রিকা ইউরোপে ভেদাভেদ নাই, সর্বত্রই এক চিত্র। একনায়কতন্ত্রী বা আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রগুলিতে গণতন্ত্রের দুর্দশা স্বভাবতই অধিক, কিন্তু বহু সমস্যার মুখেও গণতন্ত্র রক্ষণ ও লালনের চেষ্টা করিতেছে, এমন বহু দেশেও গণতন্ত্র জোর ধাক্কা খাইয়াছে।
এই আঘাত প্রকাশ্যে চোখে নাও পড়িতে পারে, কারণ তাহার অনেকাংশ বিভিন্ন রাষ্ট্র-প্রযুক্ত কোভিডকালীন নিয়মাবলির অন্তরালে চাপা পড়িয়া আছে। আফ্রিকার অনেক দেশে প্রশাসনের কঠোর লকডাউন-বিধির বলি হইয়াছেন সাধারণ মানুষ। নাইজেরিয়ায় স্থানীয় লকডাউনে কোভিড যত না প্রাণ কাড়িয়াছে, তাহার বেশি মানুষ প্রাণ হারাইয়াছেন পুলিশি জবরদস্তিতে। উগান্ডায় কোভিড-বিধিকে ঢাল করিয়া বিরোধীদের রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপে লাগাম পরাইয়াছে সরকার। গত বৎসর মার্চেই হাঙ্গেরির পার্লামেন্ট কোভিড প্রতিরোধে বিশেষ ডিক্রি জারি করিয়া প্রধানমন্ত্রীকে দেশ চালাইয়া যাইবার ক্ষমতা অর্পণ করিয়াছিল। পরে তাহা তুলিয়া লওয়া হয় বটে, কিন্তু বহু দেশে রাষ্ট্রপ্রধান বা রাজনৈতিক নেতারা কোভিডকে হাতিয়ার করিয়া ঘরে-বাহিরে নিজেদের ক্ষমতা বা আধিপত্য দৃঢ় করিয়াছেন, ইহাও সত্য। অতিমারির আবহে অন্তত ৭৫টি দেশ বা অঞ্চলে নির্বাচন বাতিল বা স্থগিত হইয়াছে। আবার যখন নির্বাচন হইয়াছে, তাহাতে রেকর্ড সংখ্যক ভোটার ভোট দিয়াছেন, সাক্ষী আমেরিকা বা দক্ষিণ কোরিয়ার নির্বাচন। কিন্তু উহা ব্যতিক্রম, গণতন্ত্রের সার্বিক চিত্রটি কোভিডকালে স্বস্তিপ্রদ ছিল না। বুরুন্ডিতে ১৯৯৩ সালের পর এই প্রথম গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কোয়রান্টিন-বিধির কারণে ছিল পর্যবেক্ষকহীন।
ব্যক্তি-স্বাধীনতাও পার পায় নাই। করোনা-আবহে লক্ষ লক্ষ মানুষ স্বেচ্ছায় নাগরিক অধিকার সমর্পণ বা ত্যাগ করিয়াছেন। কিন্তু গণতন্ত্রের খাতিরেই মানুষকে প্রতিবাদ-প্রতিরোধে পথে নামিতে হয়, তাহাও গণতন্ত্রেরই স্বীকৃত অধিকার। অতিমারি-লাঞ্ছিত বৎসরটিতে সেই অধিকার পদে পদে লঙ্ঘিত হইয়াছে। আমেরিকায় ইহার মধ্যেই ঘটিয়াছে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’-এর ন্যায় অভূতপূর্ব আন্দোলন, আবার দীর্ঘ লকডাউন কাটাইয়া, মুখে মাস্ক ও হাতে ব্যানার লইয়া, চিনা জাতীয় নিরাপত্তা আইনের বিরোধিতায় রাজপথে নামিতেই ফের ধরপাকড়ের শিকার হইয়াছেন গণতন্ত্রপ্রেমী হংকংবাসী। কোভিড-প্রতিষেধক লইয়া পুনরায় জীবনের ছন্দে ফিরিবার আবহেও মায়ানমারে ঘটিয়া গিয়াছে সামরিক অভ্যুত্থান। সমাজবেত্তারা বলিতেছেন, ২০২১-এও দেশে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়িবার আশঙ্কা। দুর্ভাগ্য। রুদ্ধবাক গণতন্ত্র মুক্তকণ্ঠ হইলে তবেই বিশ্বের অসুখ সারিবে।