সরস্বতী বন্দনা। ফাইল ছবি।
সম্প্রতি একটি পুরনো তর্ক নতুন করে উঠে এল। উঠে এল প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সূত্রে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে কি আদৌ সরস্বতী পূজা করা উচিত? ভারতের মতো ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক দেশে শিক্ষাঙ্গন কি ধর্মভাববিবর্জিত হওয়ার কথা নয়? সাধারণ ভাবে, এমন একটি প্রশ্ন যদি শিক্ষার্থীমহল থেকে উঠে থাকে, তাতে প্রসন্ন বোধ করার কথা। প্রথা বা সংস্কারকে আ-মূল প্রশ্ন করা যৌবনেরই দায়িত্ব: বিশেষত সাম্প্রতিক মিথ্যা ভাবাবেগলাঞ্ছিত দেশে ধর্মীয় প্রথার স্থানকালপাত্র নিয়ে পুনর্বিবেচনা বিশেষ সাহসের লক্ষণ। শত প্রশ্নে গণতন্ত্র বিকশিত হয়, সুতরাং প্রশ্ন সর্বদা স্বাগত।
কিন্তু এর পরও কিছু উদ্বেগ থেকে যায়। প্রথমত, ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্ম বাদ দিয়ে চলার নিরপেক্ষতা নয়, বরং সব ধর্ম ও আচারকে সমান দৃষ্টিতে দেখার নিরপেক্ষতা। সুতরাং ‘কেন সরস্বতী পূজা’ না বলে বরং কেন অন্যান্য ধর্মের উৎসব শিক্ষাঙ্গনে হতে পারে না, সেই প্রশ্নই কি বেশি যথার্থ নয়? দ্বিতীয়ত, বাংলায় কিছু কিছু পূজার ক্ষেত্রে ধর্মাচার অংশটির থেকে সংস্কৃতির আচার অংশটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সরস্বতী বন্দনা এর একটি অত্যুজ্জ্বল উদাহরণ। বহু ক্ষেত্রে পুরোহিতের স্থানে দেখা যায় ছেলেমেয়েদেরই, কিংবা তাদের অভিভাবকদের: যেন এক ঘরোয়া আরাধনার বন্দোবস্ত। গ্রামেগঞ্জে শহরেনগরে অহিন্দু ছেলেমেয়েরাও যথেষ্ট উৎসাহে এই পূজার শরিক। ফুল কুড়োনো থেকে প্রসাদভক্ষণ সবেতেই সমাজের একত্র উদ্যাপনের উদাহরণ সাহিত্য ও স্মৃতিকথায় ছড়ানো। সৈয়দ মুজতবা আলীর ছেলেবেলায় সিলেটের স্কুলে ছাত্ররা সরস্বতী পূজা আয়োজনের জন্য ফুল চুরি করায় ব্রিটিশ সাহেবদের কাছে ভর্ৎসিত হলে স্কুল বয়কটে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সদ্যকিশোর স্বয়ং মুজতবা আলী। এ-হেন কাহিনি একুশ শতকের দুষ্ট সময়েও অভাবনীয় নয়। সুতরাং সরস্বতী-সংস্কৃতিটি বন্ধ না করে এর দুয়ারটি সকলের জন্য খুলে দেওয়াই ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার প্রকৃত আদর্শ হতে পারে। বিদ্যালয়ে সরস্বতী পূজায় সম্প্রদায়-সঙ্কীর্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে, এমন যুক্তি অচল। বরং উল্টো যুক্তিতেই রবীন্দ্রনাথ দেবী আরাধনা বিষয়ে বলেছিলেন, “আনন্দময়ীর আগমনে/ আনন্দে গিয়েছে দেশ ছেয়ে,” মনে করেছিলেন, সব বিভেদ-বৈষম্য অতিক্রম করে ‘আনন্দ’কে ছড়িয়ে দিতে হবে উৎসবের পথ ধরেই। বাঙালি গৌরব বোধ করতে পারে যে, অবশিষ্ট দেশের তুলনায় সে এখনও হিন্দুধর্মের নামে সঙ্কীর্ণতা বা অসহিষ্ণুতার চর্চা করে না, বরং একটি খোলা উৎসব-আসন পাতার ব্যবস্থা করে, যাতে হিন্দু-অহিন্দু মিলে যোগ দিতে পারে। এই ধারাটিকে ধরে রাখাই সুবুদ্ধির কাজ।
প্রসঙ্গত, উনিশশো ত্রিশ-চল্লিশের দশকে বাংলার মুসলিম লীগ শিক্ষাঙ্গনে সরস্বতী পূজা বন্ধ করার চেষ্টা করেছিল। তখনও যে যুক্তি দেওয়া হয়, আজ তা আরও জরুরি বিবেচ্য: এই ঘরোয়া উৎসবগুলিকে বন্ধ করলে তাতে ধর্মীয় কট্টরতার পথটিই প্রশস্ত হয় না কি? এর ফলে যাঁরা এমন পূজা-উৎসবের মধ্যে কড়া ধর্মাচারের বদলে স্নিগ্ধ সংস্কৃতিটিকেই দেখেন, প্রয়োজনে উদার ও গ্রহিষ্ণু হতে জানেন, তাঁদেরও একটি সাদাকালো বিভাজন দিয়ে বিপরীত দিকে কট্টরতার কোলে ঠেলে দেওয়া হয়। রাজনীতির কৌশল এই বিভাজনকে বাড়ানোর ভূমি প্রস্তুত করে। একুশ শতকে এসে আজ বিষয়টির আরও গভীর বিবেচনা হোক।