Karnataka Assembly Election 2023

ভিন্ন মতের ঐতিহ্য

কে বাসবান্না? আনুমানিক ১১৩১ সালে কর্নাটকে জন্মানো সাধক-কবিকে মোদী বা শাহের মনে রাখার কথা নয়। কিন্তু তাঁর সৃষ্ট আন্দোলনটি মনে রাখার মতোই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০২৩ ০৪:৪৪
Share:

মহাপরাক্রমশালী বজরংবলীও তা হলে পারলেন না, কর্নাটকে বিজেপিকে বাঁচাতে। ফাইল ছবি।

মহাপরাক্রমশালী বজরংবলীও তা হলে পারলেন না, কর্নাটকে বিজেপিকে বাঁচাতে। পুরাকথা, কর্নাটকের হাম্পি শহরে তুঙ্গভদ্রা নদীর পাশে অঞ্জনাদ্রি পাহাড়ে হনুমানের জন্মস্থান। জায়গাটিকে সুগম করতে কর্নাটকের বাসবরাজ বোম্মাই সরকার বছরের শুরুতে সেখানে একশো কোটি টাকা বরাদ্দও করেছে। হনুমানের অবশ্য একটাই জন্মস্থান নয়। রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, গোয়া অনেক ভাগীদার আছে। কিন্তু সে সব রাজ্যে এই মুহূর্তে নির্বাচন ছিল না, প্রধানমন্ত্রীকেও উদ্বেগে সে সব জায়গায় সম্প্রতি বারংবার ছুটে যেতে হয়নি। নির্বাচনী জনসভায় কংগ্রেস ক্ষমতায় এসে বজরং দলকে নিষিদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে জেনে প্রধানমন্ত্রী সটান অযোধ্যায় রামমন্দিরের কথা টেনে বিরোধীদের বিঁধে বলেন, প্রথমে ওরা রামকে তালাবন্ধ করেছিল। এখন জয় বজরংবলী বললেও থানায় পুরে দেওয়ার ভয় দেখাচ্ছে। এ দিকে হরেক কাজের ব্যস্ততায় হয়তো প্রধানমন্ত্রীর মনে নেই, তিনিই কিন্তু ২০১৫ সালে লন্ডনে টেমস নদীর পাশে প্রবাসী ভারতীয়দের তৈরি বাসবান্না মূর্তির উদ্বোধন করেছিলেন। বিদেশের মাটিতে বাসবান্নার সেটিই প্রথম মূর্তি, যে বাসবান্নার কন্নড় ভাষায় ছোট্ট কবিতা বা বচন আছে: ‘ধনীরা মন্দির বানায়। আমার মতো গরিব কী করবে প্রভু?’

Advertisement

কে বাসবান্না? আনুমানিক ১১৩১ সালে কর্নাটকে জন্মানো সাধক-কবিকে মোদী বা শাহের মনে রাখার কথা নয়। কিন্তু তাঁর সৃষ্ট আন্দোলনটি মনে রাখার মতোই। নির্বাচন এলেই কর্নাটকে দলমত নির্বিশেষে সকলে লিঙ্গায়েত আর ভোক্কালিগা জনগোষ্ঠীকে তুষ্ট করতে নেমে পড়ে। এ বারেও বোম্মাই সরকার চেষ্টা করেছে, দুই দিকেই জনপ্রিয়তা কুড়োতে। বেশির ভাগ ভোক্কালিগা আগে জৈন ছিলেন, পরে মধ্যযুগে হিন্দু হয়ে ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। এ দিকে গৌড়ীয় বৈষ্ণব শ্রীচৈতন্যেরও চারশো বছর আগে শৈব ধর্মকে জাতপাতহীন, সমান অধিকারের নতুন লিঙ্গায়েত ধর্মে ঢেলে সাজান বাসবান্না। কলচুরি রাজাদের অধীনে কোষাধ্যক্ষের চাকরি দিয়ে তাঁর যাত্রা শুরু, কালক্রমে মন্ত্রীও হন। জাতপাত নির্বিশেষে লিঙ্গায়েত নারী-পুরুষরা যে আজও গলায় শিবলিঙ্গ এবং রুদ্রাক্ষের মালা রাখেন, তা বাসবান্নার তৈরি নিয়ম। ‘অনুভবমণ্ডপ’ নামে মিলনস্থল চালু করেছিলেন বাসবান্না, সেখানে চাষি, ধোপা, জেলে এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই একত্র বসে কন্নড় ভাষায় নিজেদের অনুভবের কথা বলত। কবিতার আকারে এই ছোট ছোট কথাগুলিকে ‘বচন’ বলা হয়। ব্রাহ্মণ এবং পণ্ডিতরা তখনও সংস্কৃত ভাষার মোহজালে। ভারতবর্ষ গণতন্ত্রের পীঠস্থান হোক বা না হোক, বাসব বহু দিক থেকেই আজকের আধুনিকতার পূর্বসূরি। এ কে রামানুজন প্রথম এই বচনগুলি কন্নড় থেকে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন, ব্রিটিশ কবি টেড হিউজ় সেই বই পড়ে এত অনুপ্রাণিত হন যে, নিজেও ছোট ছোট বচন লিখতে শুরু করেন। হাল আমলের মন্ত্রিবরদের অবশ্য এটা না জানার কথা নয় যে, তাঁদের রাজত্বকালেই একটি ইংরেজি সঙ্কলনের ভারতীয় সংস্করণ থেকে রামানুজনের ‘তিনশো রামায়ণ’ রচনাটি উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

মূল কথা, বাসবান্নার মধ্যেই গণতন্ত্রের কন্নড় ঐতিহ্য খুঁজে পাওয়া সম্ভব। গরিব মানুষ অজস্র অর্থব্যয়ে মন্দির তৈরি করতে পারবে না ঠিকই, আর তাই বাসবের বচন: ‘‘আমার পদযুগল দুই স্তম্ভ, দেহ মন্দির আর মাথাই স্বর্ণশিখর। হে নদীসঙ্গমের প্রভু, তুমি জানো স্থির বস্তু ধ্বংস হয়। গতিমত্তাই রয়ে যায়।’’ কন্নড় নাট্যকার গিরিশ কারনাড একদা বলেছিলেন, বাসব ও তাঁর শিষ্যরা কোনও স্থায়ী কাঠামোয় বা মন্দিরে বিশ্বাসী নন— আমজনতার সঙ্গে কথা বলার ক্ষেত্রে তাঁরা জঙ্গমতায় বিশ্বাস রাখতেন। এখানেই ওঁরা আধুনিক। শিবকে কখনও শিব-মহাদেব-রুদ্র এ সব নামে ডাকেননি বাসব, বেদ থেকে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের ত্রিমূর্তি, সবেরই বিরুদ্ধে তিনি। বাসবের উত্তরাধিকার আসলে ভিন্ন মতের, ভিন্ন রুচির অধিকার। তবে ভোট-রাজনীতিতে লিঙ্গায়েত যে এক দিন আলাদা জাতি হিসাবে গণ্য হবে, জানতেন না এই সাধক-কবি। প্রসঙ্গত, বাসবকে নিয়ে আধুনিক এক পণ্ডিত অনেক গবেষণা করেছিলেন, কয়েক বছর আগে যিনি আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারান। তাঁর নাম ছিল এম এম কালবুর্গি। যাঁরা তাঁর প্রাণ নিয়েছিলেন, তাঁরা স্পষ্টতই ভিন্ন রুচির উত্তরাধিকারের বিরোধী। কর্নাটকে নির্বাচনের ফলাফলকে খুব বেশি গৌরবান্বিত না করেও মনে করা যায় যে, এই সেই কন্নড় রাজ্য যার মাটিতে জীবনের বিনিময়েও ভিন্ন মতের ঐতিহ্য প্রবহমান রেখেছিলেন এখানকার ভূমিপুত্ররা।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement