TMC Inner Conflict

সঙ্কট-মূল

সাধারণ ভাবে দেখলে, প্রবীণ-নবীনে মতের অমিলকে অভিনব বলা চলে না। গৃহকোণ থেকে বৃহত্তর সামাজিক পরিসর, সর্বত্রই এর ছায়াপাত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০২৪ ০৭:৪৬
Share:

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।

তৃণমূল কংগ্রেসের সৃষ্টিকর্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র তথা দলের ‘নব্য নায়ক’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে রাজনৈতিক ঠোকাঠুকির খবর এখন সর্বজ্ঞাত। তবে বিষয়টি শুধুই একটি দলের অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসাবে দেখলে অতিসরলীকরণের ঝুঁকি থেকে যেতে পারে। কারণ, তৃণমূল এখন রাজ্যের শাসক। আর ক্ষমতাসীন দলে সংহতির অভাব প্রকাশ পেলে প্রশাসনের উপরেও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা স্বাভাবিক। এমতাবস্থায় আমলা ও পুলিশমহলের একাংশ নিজেদের মতো করে ক্ষমতার ‘ভরকেন্দ্র’ খুঁজে নিতে ব্যগ্র হয়ে ওঠে। কিয়দংশ আবার বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যায়। এর কোনওটিই প্রশাসনের সুষ্ঠু পরিচালনায় বাঞ্ছনীয় নয়। উপরন্তু দুয়ারে লোকসভা ভোট। সব মিলিয়ে তাই উদ্ভূত পরিস্থিতি যথেষ্ট জটিল।

Advertisement

সাধারণ ভাবে দেখলে, প্রবীণ-নবীনে মতের অমিলকে অভিনব বলা চলে না। গৃহকোণ থেকে বৃহত্তর সামাজিক পরিসর, সর্বত্রই এর ছায়াপাত। তৃণমূল কংগ্রেসে দ্বন্দ্বের যে চেহারা প্রকট হয়ে উঠেছে, তা দলের শিকড়ে কুঠারাঘাত করবে কি না, সেই প্রশ্নও এড়ানো যাচ্ছে না। প্রজন্ম বদলের অর্থ নতুন নেতৃত্বের উত্থান। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কোনও সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানকে গতিশীল রাখতে হলে এর প্রয়োজনীয়তা স্বীকার না করার কারণ নেই। অতীতে মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টি ওই পথে হাঁটত না। দীর্ঘকাল যাবৎ তাদের দলের শীর্ষস্তরে ‘বৃদ্ধতন্ত্র’ কায়েম ছিল। সাধারণ সম্পাদক হওয়ার গড় বয়স ঘোরাফেরা করত সত্তর-আশির কোঠায়। ২০০৫ সালে সেই ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়ে। প্রকাশ কারাট সাধারণ সম্পাদক হন সাতান্ন বছর বয়সে। তাঁর পরে সীতারাম ইয়েচুরি তেষট্টিতে। ১৯৬৯ সালে ইন্দিরা গান্ধী যখন তৎকালীন মূল কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে ‘নব’ কংগ্রেস গড়েন, তখন পুরনো অর্থাৎ ‘আদি’ কংগ্রেসও ছিল ‘বৃদ্ধ’ নেতাদের দখলে। এই সব দৃষ্টান্ত সামনে রাখলে হয়তো মনে হতে পারে, তৃণমূলে নবীন-প্রবীণ দ্বন্দ্ব নিয়ে চর্চা অকিঞ্চিৎকর। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দলটি তৃণমূল বলেই বিষয়টি গভীর অর্থবাহী। কারণ, পঁচিশ বছরের অভিযাত্রায় এই দল সর্বার্থে ‘মমতাময়’। দলের নেতা, কর্মী, সমর্থক, ভোটার সবাই একবাক্যে মেনে এসেছেন, মমতার বিকল্প নেই। ভেবে দেখলে, নব্য নেতাকে তুলে ধরার উদ্যোগের বীজটিও কিন্তু বপন করেছেন দলের সর্বাধিনায়িকা স্বয়ং। তাই আজ যা ঘটছে, তার ভাল-মন্দ কোনও দায়ভারই দলনেত্রী পুরোপুরি এড়িয়ে যেতে পারেন না।

লক্ষণীয়, ২০১৪ সালে প্রথম সাংসদ হন অভিষেক এবং ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনেই দলের জয়ের দাবিদার হিসাবে তাঁর নামে হোর্ডিং কলকাতা ছেয়ে যায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা দলের ‘প্রবীণ’ নেতারা সে দিন প্রকাশ্যে একটি কথা বলেননি। পরিবর্তে, পিসির দলে ভ্রাতুষ্পুত্রই অনিবার্য উত্তরসূরি, এই বার্তা স্পষ্ট করে নব্য-প্রজন্মের হাতে ক্রমশ ক্ষমতার রাশ তুলে দিয়ে অভিষেককে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক পর্যন্ত করেছেন মমতা। অভিষেকের কেতাদুরস্ত উপস্থিতি, আধুনিকমনস্কতা, কর্পোরেট কায়দায় দল পরিচালনার পদ্ধতি ইত্যাদি নজরও কেড়েছে দ্রুত। বিশেষত ২০২১-এ দোলাচলের বিধানসভা নির্বাচনে ভোট-কুশলীকে ডেকে এনে ‘যুদ্ধজয়’ অভিষেকের অবস্থান আরও দৃঢ় করে দেয়। সেই থেকে তাঁর সাংগঠনিক পরিচালন পদ্ধতিতে এক দিকে দলের ‘পুরনো’ অংশ নিজেদের অপাঙ্‌ক্তেয় ভাবতে শুরু করেন, অন্য দিকে রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসনেও নব্য নেতার ‘ভূমিকা’ আলোচ্য হয়ে ওঠে। আর এখন মনে হচ্ছে, পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে দল ও সরকারের কান্ডারি হিসাবে মমতা তাঁর আলগা করে-দেওয়া রাশ ফের শক্ত হাতে ধরতে চাইছেন বলেই নবীন প্রজন্মের এত ধৈর্যচ্যুতি, এত অস্থিরতা। এর পরিণতি ভবিষ্যতের গর্ভে, শাসক দলের এই আলোড়ন দলের স্বাস্থ্য-বিষয়ক এক সতর্কবার্তা বইকি।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement