দক্ষিণ কলকাতার ‘ফুসফুস’ রবীন্দ্র সরোবর অঞ্চলটিকে ঘিরে পরিবেশপ্রেমীদের উৎকণ্ঠা অমূলক নয়। ফাইল ছবি।
ফুসফুস যদি বিকল হয়, তবে শরীর কি সুস্থ থাকতে পারে? দক্ষিণ কলকাতার ‘ফুসফুস’ রবীন্দ্র সরোবর অঞ্চলটিকে ঘিরে পরিবেশপ্রেমীদের উৎকণ্ঠা তাই অমূলক নয়। ১৯০ একর জায়গা জুড়ে থাকা এই সরোবর নিছকই এক জলাশয় নয়। কংক্রিটের জঙ্গলের মাঝে সবুজে মোড়া এই চত্বর খানিক স্বস্তির শ্বাস নেওয়ার ঠিকানাও বটে। কিন্তু এই গ্রীষ্মে সেখানে জলস্তর যে উদ্বেগজনক ভাবে কমেছে, তা ইতিপূর্বে কখনও দেখা যায়নি। সরোবরের একাংশে চর পড়ে সেখানে ঘাস জন্মাতে দেখা গিয়েছে। কোথাও আবার জল শুকিয়ে বেরিয়ে এসেছে ঘাটের কাঠামো। গ্রীষ্মে জলাশয়ের জল শুকিয়ে যাওয়া কোনও অপ্রত্যাশিত ঘটনা নয়। কিন্তু রবীন্দ্র সরোবরের মতো এক সুবিশাল জলাশয়, যাকে ঘিরে দীর্ঘ কাল ধরে এক অমূল্য বাস্ততন্ত্র গড়ে উঠেছে, তার ক্ষেত্রে এমন পরিণতিকে নিছক ‘ঘটনা’ বলে অবহেলা করা চলে না। উদ্বেগ সঙ্গতই।
জলস্তর হ্রাসের একটি সম্ভাব্য কারণ হিসাবে উঠে আসছে সরোবরের চার পাশে ক্রমবর্ধমান বহুতলের সংখ্যা। এর কারণে মাটি থেকে যে বিপুল পরিমাণ জল তুলে নেওয়া হচ্ছে, তার বিরূপ প্রভাব পড়ছে সরোবরের উপর। কারণটি গুরুত্বপূর্ণ, নিঃসন্দেহে। কিন্তু বহুতল নির্মাণ-সহ বিভিন্ন কারণে ভূগর্ভস্থ জলস্তরের হ্রাস পাওয়া কলকাতার ক্ষেত্রে কোনও নতুন বিপদ নয়। দীর্ঘ দিনই কলকাতা, বিশেষত দক্ষিণ কলকাতার বিভিন্ন ওয়র্ড জলস্তরের ক্ষেত্রে বিপন্ন তালিকার প্রথম সারিতে রয়েছে। সরোবর সংলগ্ন ওয়র্ডগুলিও তার বাইরে নয়। সুতরাং, শুধুমাত্র বহুতল নির্মাণকেই এই মরসুমে রবীন্দ্র সরোবরের শুকিয়ে আসার জন্য কতটা দায়ী করা চলে, তা নিয়ে আরও বিশদ ভাবনাচিন্তা প্রয়োজন। বস্তুত, সরোবরের জল শুকিয়ে আসার জন্য কোনও একটিমাত্র কারণকে দায়ী করা হয়তো অতি সরলীকরণ। এই মরসুমে গ্রীষ্মের চরিত্র বদলের ঘটনাটিও উল্লেখযোগ্য। নজিরবিহীন শুষ্ক গরমে জল অতিরিক্ত বাষ্পীভূত হয়ে যাওয়ায় এবং তদনুপাতে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় সরোবর শুকিয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। উষ্ণায়নের আবহে জলাশয়গুলির ক্ষেত্রে এমত ঘটনা যে নিয়মিতই ঘটতে থাকবে, তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা বহু আগেই সতর্ক করেছিলেন। তা ছাড়া সরোবরে পলি নিষ্কাশনের কাজটি হয়তো যথাযথ হয়নি। সে ক্ষেত্রে পলি জমে চরের জেগে ওঠাও সম্ভাব্য কারণ হতে পারে কি না, খতিয়ে দেখতে হবে সেটিও। হয়তো এমন বহুবিধ কারণের সম্মিলিত ফলই সরোবরের জলস্তর হ্রাস।
কলকাতাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে, তার জলাশয়গুলিরও বিশেষ যত্ন প্রয়োজন। অথচ, এই বিষয়ে প্রশাসন এবং নাগরিক সমাজ— উভয়েই আশঙ্কাজনক ভাবে উদাসীন। রবীন্দ্র সরোবর আগেও একাধিক বার বিপন্ন হয়েছে। ইতিপূর্বে আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও ছটপুজোর কারণে ঘটা সরোবর-দূষণ রুখতে ব্যর্থ হয়েছিল প্রশাসন। কলকাতার অন্য জলাশয়গুলির অবস্থাও তথৈবচ। এক দিকে প্রোমোটার চক্রের দৌরাত্ম্যে জলাশয়গুলি রাতারাতি উধাও হচ্ছে, অন্য দিকে নাগরিকরাও কখনও জঞ্জাল, কখনও প্লাস্টিক ফেলে জলাশয়কে বুজিয়ে দিচ্ছেন, পুজোর সামগ্রী ফেলে জলকে দূষিত করছেন। রবীন্দ্র সরোবরকে নিঃসন্দেহে বাঁচাতে হবে। কিন্তু অন্য জলাশয়গুলির ক্ষেত্রেও যেন একই পথে ভাবনাচিন্তা হয়। সজাগ হতে হবে নাগরিককে, দায়িত্ব অবশ্যই প্রশাসনের।