—প্রতীকী ছবি।
কন্যাশ্রী, রূপশ্রীর মতো প্রকল্প সত্ত্বেও নাবালিকা বিবাহ প্রতিরোধে পশ্চিমবঙ্গ পিছিয়ে অনেক রাজ্যের থেকে, এই তথ্য জাতীয় স্তরের নানা সমীক্ষায় আগেই মিলেছিল। এ বার সেই চিত্রকে আরও স্পষ্ট করল আন্তর্জাতিক পত্রিকা ল্যানসেট-এ প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে আঠারো বছর বয়সের আগেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে ৪১ শতাংশ মেয়ের, দেশে যা সর্বাধিক (জাতীয় গড় ২২ শতাংশ)। পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে আরও বেশি করে প্রশ্নের মুখে ফেলবে এই তথ্য যে, ২০১৬ থেকে ২০২১, যে সময়কালে কন্যাশ্রী প্রকল্প পূর্ণ মাত্রায় কার্যকর ছিল, সে সময়েও এই রাজ্যে নাবালিকা বিবাহের হার সামান্য বেড়েছে। অথচ, এক উত্তরাখণ্ড ছাড়া ভারতের আর সব রাজ্যে বাল্যবিবাহের হার কমেছে। বিবাহিত নাবালিকার মোট সংখ্যার নিরিখে অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের থেকে এগিয়ে বিহার— দেশের ১৬ শতাংশ বিবাহিত নাবালিকা রয়েছে সে রাজ্যে, পশ্চিমবঙ্গে সেই হার ১৫ শতাংশ, উত্তরপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রে যথাক্রমে ১২ শতাংশ ও ৮ শতাংশ। এই চারটি রাজ্যে দেশের অর্ধেকেরও বেশি নাবালিকা বিবাহ ঘটছে। অন্য দিকে, নাবালকদের বিয়ের হারেও পশ্চিমবঙ্গ শীর্ষ চারটি রাজ্যের একটি।
রাষ্ট্রপুঞ্জের লক্ষ্যমাত্রা ছিল, ২০৩০ সালের মধ্যে নাবালিকা বিবাহ নির্মূল করা। উল্লেখযোগ্য যে, ভারতে ১৯৯৩ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে সার্বিক ভাবে বাল্যবিবাহের হার কমেছে। ৪৯ শতাংশ থেকে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২২ শতাংশে। কিন্তু সব রাজ্যের ক্ষেত্রে ছবিটা সমান নয়। গবেষকদের দাবি, পশ্চিমবঙ্গে ওই একই সময়কালে বিবাহিত নাবালিকার মোট সংখ্যা বেড়েছে পাঁচ লক্ষাধিক। ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানা, রাজস্থানের মতো রাজ্য নাবালিকা বিয়ের হার কমানোতে পশ্চিমবঙ্গের থেকে বেশি সফল হচ্ছে কী করে, এই প্রশ্নটি অতিকায় হয়ে উঠছে। রাজ্য সরকারের আধিকারিকরা প্রত্যাশিত ভাবেই ল্যানসেট-এ প্রকাশিত সমীক্ষার ফল সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেছেন। অন্য রাজ্যের তুলনায় বাল্যবিবাহ পশ্চিমবঙ্গে বেশি নথিভুক্ত হয়, এমন যুক্তিও শোনা গিয়েছে। যদিও পঞ্চম জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষায় (২০১৯-২১) প্রকাশ, ২০১৫-১৬ সালের পরে রাজ্যে বাল্যবিবাহের হার কমেনি। অতএব পশ্চিমবঙ্গ যে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ব্যর্থ, সে বিষয়ে তর্ক চলে না।
এ বার কন্যাশ্রী, রূপশ্রীর মতো প্রকল্পের মূল্যায়ন করা, প্রয়োজনে সংশোধন করা প্রয়োজন। কেন শিক্ষাবিচ্যুত হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের বালিকা-কিশোরীরা, কেন নানাবিধ প্রচার সত্ত্বেও তাদের স্কুলমুখী করা যাচ্ছে না, কারণটি বুঝতে হবে। পাশাপাশি, বাল্যবিবাহ রোধে সামাজিক দায়িত্বটিও কিছুমাত্র কম নয়। রামমোহন, বিদ্যাসাগরের মাহাত্ম্য নিয়ে নানা উদ্যাপন-আস্ফালন চলে বটে, তবে ‘কেলেঙ্কারি’ এড়াতে কিংবা খরচ কমাতে মেয়ের দ্রুত বিয়ে দেওয়ার ঝোঁকটি বঙ্গদেশের বাবা-মাকে এখনও ছাড়ল না। শিক্ষার হার বাড়লেই নাবালিকা বিবাহ কমবে, এমন ভরসাও নেই— পূর্ব মেদিনীপুর, পূর্ব বর্ধমানের মতো শিক্ষায় অগ্রসর জেলাগুলিতেও নাবালিকা বিবাহের হার বেশি। মেয়েদের যৌনতাকে নিয়ন্ত্রণ করার ইচ্ছাকে কেবল প্রথাগত শিক্ষা দিয়ে খারিজ করা যাবে না।