—ফাইল চিত্র।
এটা চমকে দেওয়ার মতো বাজেট, বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর সঙ্গে একমত না হওয়ার বিন্দুমাত্র কারণ নেই। লোকসভা ভোট আসছে— যদিও তার সঙ্গে আদর্শ পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকারের কোনও লেনদেন থাকার কথা নয়— তবু সেই ভোটের কথা মাথায় রেখে মুখ্যমন্ত্রী হাত উপুড় করেছেন, চমক এখানে নয়। সরকারি কর্মচারীদের ডিএ বেড়েছে, সিভিক ভলান্টিয়ার থেকে শুরু করে হরেক কিসিমের চুক্তিভিত্তিক কর্মীর প্রাপ্যের পরিমাণও বেড়েছে। লক্ষ্মীর ভান্ডারে ভাতার পরিমাণ বেড়েছে, বার্ধক্য ভাতাও। মিড-ডে মিল কর্মী থেকে মৎস্যজীবী, সবাই কিছু না কিছু পাচ্ছেন। সে টাকা আসবে কোথা থেকে, চমক রয়েছে সেই প্রশ্নের উত্তরে। যে রাজ্যে শিল্প নেই, বাণিজ্য নেই, যেখানে যথেষ্ট রাজস্ব আদায় হয় না, সে রাজ্যে টাকার ব্যবস্থা করার সহজতম পন্থাটি হল আরও বেশি ধার করা। এই বাজেটে রাজ্য সরকার সে পথে বেপরোয়া হেঁটেছে। বাজার থেকে আরও বেশি ঋণ নিতে মনস্থ করেছে, কেন্দ্রীয় সরকারের থেকেও ঋণের পরিমাণ বাড়বে বলেই আশা। এ বছর সরকার বাজেটবহির্ভূত খাতে ধার করে বিভিন্ন প্রকল্পের খরচ চালিয়েছে বলে খবর। সেটাও সম্ভবত অর্থসংস্থানের উপায়।
এখানে দু’টি কথা মনে করিয়ে দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ— এক, বাম আমলের যে বিপুল ঋণের উত্তরাধিকার বর্তমান শাসকরা পেয়েছিলেন, তার তুলনায় পরিস্থিতি ঘোরতর না হলেও রাজ্যের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের অনুপাতে ঋণের পরিমাণ ভারতের যে রাজ্যগুলিতে সবচেয়ে বেশি, পশ্চিমবঙ্গ সেগুলির অন্যতম; এবং দুই, ঋণগ্রস্ত রাজ্য যদি বাজার থেকে আরও ঋণ করতে চায়, তবে স্বভাবতই সুদের হার বাড়ে, ফলে ঋণ আরও মহার্ঘ হয়ে ওঠে। এমনিতেই রাজস্ব ব্যয়ের সিংহভাগ শুধু বকেয়া ঋণের সুদ-আসল মেটাতে খরচ হয়, এর পর তা আরও বাড়লে সে টাকার জন্য কি ফের ঋণ করবে রাজ্য সরকার? ঋণের দুষ্টচক্র এ ভাবেই চলে, মনে রাখা ভাল। অন্য দিকে, কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে বিভিন্ন খাতে রাজ্যের প্রাপ্যের পরিমাণ গত অর্থবর্ষের চেয়ে এ বার তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বাড়বে বলেই বাজেটে আশা। তা ‘কেন্দ্রীয় বঞ্চনা’র রাজনৈতিক বয়ানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কি না, তার চেয়ে অনেক গুরুতর প্রশ্ন হল, এই বাড়তি টাকা না মিললে কি তা-ও বাজার থেকে ধার করা হবে? পুরোটা বাজেটে বলতে দৃষ্টিকটু লাগে, তাই কি কেন্দ্রের প্রতি আশার ছল?
ধার করে যে টাকার সংস্থান হবে, তা খরচ হবে কিসে? রাজ্য সরকারের বিবিধ প্রকল্প তো আছেই, তা ছাড়াও জানা গিয়েছে যে, কেন্দ্র যে সব খাতে টাকা দিচ্ছে না, এ বার রাজ্য নিজের টাকায় সেই সব খরচ করবে। যথা, বছরে পঞ্চাশ দিন কর্মসংস্থান হবে কর্মশ্রী প্রকল্পে। মুখ্যমন্ত্রী যে কথাটি বুঝতে নারাজ, অথচ যা না বুঝলেই নয়, তা হল, কেন্দ্রের প্রতি গোসা করে ঘরে খিল দেওয়া রাজ্য সরকারের অবশ্যকর্তব্য নয়। রাজ্যের কাজ হল কেন্দ্রের থেকে প্রাপ্য টাকা আদায় করে আনা— তা কেন্দ্রে যে দলেরই সরকার থাকুক না কেন। কেন্দ্রের থেকে টাকা না নিয়ে নিজের টাকাতেই সব করব, এ কথা বলার এবং তা করে দেখানোর সাধ্য ভারতের কোনও রাজ্যেরই নেই, পশ্চিমবঙ্গের তো নয়ই। যে প্রকল্পগুলি রাজ্যের নিজস্ব, সেগুলির খরচও আর কত দিন ধারদেনা করে চলবে? উন্নয়ন খাতে খরচ করা ভাল, প্রত্যক্ষ নগদ হস্তান্তরও অযৌক্তিক নয়— কিন্তু সবার থেকে ভাল কাজগুলি করার জন্য যথেষ্ট রাজস্ব উপায়ের ব্যবস্থা করা। তার জন্য শিল্পায়নে গুরুত্ব দিতে হবে। সে অন্য সাধনার ফল, রাজ্য প্রশাসনের সম্ভবত তাতে রুচি নেই। বিভিন্ন প্রকল্পের খাতে যে খরচ রাজ্য সরকার করে চলেছে, সেগুলিতে প্রত্যাশিত ফল মিলছে কি না, অন্তত সেই খোঁজটুকু করা হোক। রাজকোষের টাকা খরচ করে নাগরিকের কতখানি উপকার হল, সেই হিসাবটুকুও যদি না থাকে, তা হলে প্রশাসনের আর থাকে কী?