ফাইল চিত্র।
নরেন্দ্র মোদীকে কোনও বিষয়ে পরামর্শ দিবার হয়তো কোনও অর্থই হয় না, তাঁহার অনন্ত বাগাড়ম্বর শুনিয়া চলাই অন্যদের কাজ। তবু এই গোড়ার কথাটুকু আরও এক বার তাঁহাকে না বলিলেই নয় যে— ক্ষমতা থাকিলে দায়িত্বও থাকে। তাঁহার এবং তাঁহার সরকারের আচরণে এই প্রাথমিক সত্যের কোনও স্বীকৃতি আজ অবধি বিশেষ দেখা যায় নাই। গদিতে বসিবার পরের মুহূর্ত হইতে তাঁহারা আপন ক্ষমতা দেখাইতে যতটা ব্যগ্র, জনসাধারণের ভালমন্দের দায়িত্ব লইতে ততটাই নারাজ। দেশবাসীর উদ্দেশে তাঁহার মঙ্গলবারের সান্ধ্য ভাষণে সেই মানসিকতাই আরও এক বার প্রকট হইয়াছে। অতিমারির মোকাবিলার দায়দায়িত্ব তিনি কার্যত রাজ্য সরকার, বাজার এবং জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দিয়াছেন। মোদী দেশের প্রধানমন্ত্রী। এই আসনটির প্রতি সামান্যতম মর্যাদার বোধ অন্তরে থাকিলেও তিনি বুঝিবেন যে, তাঁহার আচরণ অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক, বস্তুত লজ্জাকর। অবশ্য বুঝিলেও, সেই মন কি বাত যে তিনি উচ্চারণ করিবেন না, সেই বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।
দায়িত্ব পালনের দুইটি প্রধান উপায়: যাহা করিবার তাহা করা, এবং যাহা করিবার নহে তাহা না করা। একটি দায়িত্বশীল সরকারের যাহা করিবার, নরেন্দ্র মোদীর জমানায় তেমন প্রচেষ্টার দৃষ্টান্ত বিরলতম। অন্য প্রসঙ্গ থাকুক, অতিমারির মোকাবিলায় এই সরকারের চূড়ান্ত ঔদাসীন্য এখনও চলিতেছে। অকল্পনীয় সঙ্কটে দরিদ্র ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াইবার ব্যাপারে নিষ্ক্রিয় ও অপদার্থ রাষ্ট্রগুলির মধ্যে ভারত প্রথম সারিতে স্থান লইয়াছে। কোভিডের ‘প্রত্যাবর্তন’ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যে ভয়াবহ আকার ধারণ করিয়াছে তাহার পিছনেও কেন্দ্রীয় সরকারের দীর্ঘ নিষ্ক্রিয়তার ভূমিকা বিরাট। ভ্যাকসিন উৎপাদন ও আমদানির নীতি নির্ধারণে প্রকাণ্ড ভ্রান্তির কাহিনি ইতিমধ্যে বহু-আলোচিত, প্রকাণ্ডতর ঔদ্ধত্যের কারণে দিল্লীশ্বররা আজও যে ভ্রান্তি স্বীকার করেন নাই। উপরন্তু প্রধানমন্ত্রী এখন, অগণন দেশবাসীর অসহায় বিপন্নতার মধ্যে দাঁড়াইয়া, অম্লানবদনে সরকারের ‘কৃতিত্ব’ লইয়া গর্ব করিতেছেন! প্রকৃত সত্য তাঁহার প্রচারের সম্পূর্ণ বিপরীত। পূর্ববর্তী সরকারের বিরুদ্ধে যে নীতিপঙ্গুতার অভিযোগ নরেন্দ্র মোদীর নির্বাচনী অভিযানের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার ছিল, এই অতিমারির কালে তাঁহার সরকারের আচরণে সেই নীতিপঙ্গুতাই দেশের মানুষকে— আক্ষরিক অর্থে— ধনেপ্রাণে মারিতেছে।
কিন্তু তাহার পাশাপাশি যাহা করিবার নহে, করা উচিত নহে, মোদী ও তাঁহার পারিষদরা বেপরোয়া ভাবে তাহা করিয়া চলিয়াছেন। পশ্চিমবঙ্গে সংক্রমণ মাত্রা ছাড়াইবার পরে বিভিন্ন দল ও দলনেতা তাঁহাদের নির্বাচনী প্রচারের কর্মসূচি নানা ভাবে কাটছাঁট করিয়াছেন। আরও আগে করা উচিত ছিল, কাটছাঁটের ঘোষণা বাস্তবে কার্যকর করাও উচিত ছিল, কিন্তু অন্তত নেতারা নিজেদের প্রচার কিছুটা সংযত করিতেছেন, এই সঙ্কেতটুকু গুরুত্বপূর্ণ। বিজেপিও, অন্যদের পরে এবং স্পষ্টতই চাপে পড়িয়া, আপন প্রচারের বাহুল্য কিছুটা নিয়ন্ত্রণের কথা জানাইয়াছে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতেও নরেন্দ্র মোদীর চারটি জনসভা অনুষ্ঠিত হইবে! প্রশ্ন একটিই: আর কেন? কয়েক সপ্তাহ ধরিয়া তাঁহার প্রচার এই রাজ্যের মানুষ বিস্তর শুনিয়াছেন, এমনিতেও দিদি-কীর্তন এই বার থামিলে বঙ্গবাসী রেহাই পাইতেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী আসিবেন, ‘নিয়ন্ত্রিত’ জনসভা করিবেন এবং সংক্রমণের সম্ভাবনা বাড়াইবেন। অন্যেরা অন্যায় করিতেছে বলিয়া কেহই অন্যায় করিবার নৈতিক অনুমোদন পায় না। কিন্তু দেশের প্রধানমন্ত্রী এই যুক্তি দিলে তাহা কেবল অনৈতিক নহে, অপরাধের শামিল হইয়া দাঁড়ায়। কে কী করিতেছে, তাহা না ভাবিয়া নরেন্দ্র মোদীর কর্তব্য ছিল সর্বাগ্রে নিজের জনসভা সম্পূর্ণ বাতিল করা। কিন্তু আবারও বলিতে হয়, কাহার সাধ্য নরেন্দ্র মোদীকে ন্যায়-অন্যায় বুঝাইবে?