—প্রতীকী ছবি।
আগামী কাল বাসন্তী বাতাসে, যমুনাপুলিনের নীপবনে শ্রীরাধা ও গোপীদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর সঙ্গী গোপ-গোপিনীদের ফাগ উৎসবের রঙিন আনন্দে মাতোয়ারা হওয়ার দিন। অযোধ্যায় সম্প্রতি রামলালার বিশাল মন্দির ভক্তজনের জন্য দুয়ার খুলেছে, সত্য। কিন্তু আরও বড় সত্য হল, হিন্দুর ধর্মে কোনও একমেবাদ্বিতীয়ম্ ‘ভ্যাটিক্যান সিটি’ নেই, রামলীলার পাশাপাশি শ্রীমদ্ভাগবত এবং কৃষ্ণলীলাও দেশ জুড়ে ভক্তরসিকদের আশ্রয়। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি দ্বারকার সমুদ্রস্রোতে ডুবুরির পোশাকে নেমে শ্রীকৃষ্ণ স্মরণে অর্ঘ্য অর্পণ করেছেন ঠিকই, কিন্তু দোলের সঙ্গে রুক্মিণীপতি দ্বারকাধীশ সম্পর্কহীন। দ্বারকার শ্রীকৃষ্ণ রাজা, বৃন্দাবনের শ্রীকৃষ্ণ গোপবালক মাত্র। ফাগ খেলার শেষে গোপীরা রাধা ও কৃষ্ণকে দোলায় বসিয়ে দুলিয়েছিল, সেখান থেকেই বাংলার দোলযাত্রা, ওড়িশার দোলোৎসব। প্রেমের মদনদেবতা এই উৎসবে অলক্ষ্যে বিরাজমান। তাই গোয়া, কোঙ্কন অঞ্চলে উৎসবের নাম শিমাগা, দক্ষিণ ভারতে মদনদহন। রং খেলার উৎসবটি দেশ জুড়ে, কিন্তু সে উৎসবের নানা চেহারা, নানা নাম, নানা ঐতিহ্যই বুঝিয়ে দেয়, দেশকে ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান’-এর জোড়কলমে বাঁধতে চাওয়া অসম্ভব, এক ভ্রান্ত খোয়াবনামা।
বরং এই রং বহুত্ববাদী গণতন্ত্রের। শ্রীচৈতন্যের জন্মতিথি অবশ্যই, কিন্তু তার পাশাপাশি শিব, জ্যোতিষ, পুরাণ সবই এই উৎসবের স্মৃতিতে। পুরীর মন্দিরে আজও দোলের আগে একটি ভেড়ার গায়ে আলতো করে আগুন ছুঁইয়ে দেওয়া হয়। কারণ হোলি কথাটা এসেছে হোলাকার থেকে। এর মানে, মেষ বা ভেড়া। এই মেষ আবার ভাদ্রপাদ নক্ষত্রের প্রতীক। সংস্কৃতে মেণ্ঢাসুর। প্রাচীন ধারণা, এই মেণ্ঢাসুর সূর্যকে উত্তরায়ণে আসতে বাধা দেয়। সেই অসুর দমনেই উৎসব। আর এক মত, ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমায় চন্দ্র বিশাখা নক্ষত্রের সঙ্গে মিলিত হয়। অথর্ব বেদে সেই নক্ষত্রের আর এক নাম রাধা। সেখান থেকেই রাধাকৃষ্ণ মিলনের রূপকল্প। শিবপুরাণের মতে আবার শঙ্খচূড় দানবকে বধ করার জন্য বিষ্ণু শিবকে কবচকুণ্ডল দান করেন। সেখান থেকেই দোল। ছুটির ক্যালেন্ডারে দোল এবং হোলি আগামী কাল একাকার, কিন্তু হোলির রূপকল্প অন্য। সেখানে হোলিকাদহনের স্মৃতি। দানবরাজ হিরণ্যকশিপু তাঁর পুত্র প্রহ্লাদকে আগুনে পুড়িয়ে মারার নির্দেশ দিয়েছিলেন। হিরণ্যকশিপুর বোন হোলিকা শিশু প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে একটি ঘরে ঢুকে যান, সেখানে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। বিষ্ণুভক্ত শিশুর গায়ে বিন্দুমাত্র আঁচড় লাগে না, কিন্তু হোলিকা সেই দাউদাউ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যান। আজও অনেক জায়গায় হোলির আগের রাতে তাই বুড়ির ঘর পোড়ানো বা চাঁচর উৎসব। প্রেমের ফাগ এবং ফুলডোরে বাঁধা ঝুলনার পাশাপাশি ক্ষমতার এই বয়ানটিও লোক-উৎসবে রয়ে গেল। আজও বিহার, উত্তরপ্রদেশে হোলির দিন আনন্দমুখর খিস্তিখেউড়ের গান। উৎসবে আবির এবং পিচকিরির রংটিই সব নয়, তার উৎসে বিষ্ণু, শিব, জ্যোতিষ, লোকবিশ্বাসের হরেক রং। সেখানেই গণতন্ত্র।
গণতান্ত্রিক এই উৎসব কখনও হিন্দু-মুসলিম পরোয়া করেনি। কখনও অওধের নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ শ্রীকৃষ্ণ সেজে দোল খেলেন, আবার কখনও মেহবুব খানের মাদার ইন্ডিয়া ছবিতে দোলের সঙ্গীতমুখর দৃশ্য। স্বাধীনতারও আগে ১৯৪০ সালে, লাহোরে ফিল্মি দুনিয়ার প্রতিষ্ঠাতা আব্দুর রশিদ কারদার হোলি নামের একটি ছবি তৈরি করেছিলেন। ফাগুন ছবিতে হোলির গানের গীতিকার শুধু মুসলমান নন, জেলখাটা কমিউনিস্ট মজরু সুলতানপুরী। খুঁটিয়ে দেখলে, মেয়েদের প্রগতিও হিন্দি ছবির হোলি দৃশ্যে পরিষ্কার। বিখ্যাত ছবির বিখ্যাত হোলির গানে প্রেমিক পুরুষরাই সব। মেয়েরা শুধুই লজ্জার আবিরে রাঙা। অন্য দিকে হাল আমলের ছবিতে নায়িকাই নায়ককে রং দিতে ছুটে যান। তা ছাড়া, দোল তো শুধুই বিশেষ একটি তিথির উৎসব নয়। যেমন, রাধার বাড়ি বরসানায় দোলখেলা ইতিমধ্যেই শেষ। বৃন্দাবনের সপ্তাহব্যাপী দোল উৎসব ওই অঞ্চলেই শুরু। সেখানে মেয়েরা কাঠিনাচ নাচে, ফাগ ওড়ানোয় মাতে। পাশের নন্দগাঁও থেকে ছেলেরাও আসে। কারণ, দু’দিন পরেই শ্রীকৃষ্ণের পালক পিতা নন্দ মহারাজের এলাকা নন্দগাঁওতে দোল। সেখানে রঙের উৎসব সম্পন্ন হলে, অবশেষে বৃন্দাবন। দোলের মিথ বা পুরাকথা এই ভাবেই হরেক এলাকার হরেক ঐতিহ্যকে গণতান্ত্রিক ভঙ্গিতে অটুট রাখে। তাই প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বাধীন কমিটি ‘এক দেশ, এক ভোট’-এর পক্ষে যতই সুপারিশ করুন, এক দেশ এক দোল এ দেশে হয়নি, হবেও না।