— ছবি সংগৃহীত
আমাদের প্রজন্মের মহত্তম মানুষটির আকাঙ্ক্ষা হইল প্রতিটি মানুষের চক্ষু হইতে প্রতিটি অশ্রুবিন্দু মুছিয়া ফেলা। সেই সাধ্য হয়তো আমাদের নাই, কিন্তু যত দিন মানুষের চক্ষুতে অশ্রুবিন্দু থাকিবে, আমরা জানিব যে, আমাদের কাজ শেষ হয় নাই।” ১৫ অগস্ট মধ্যরাতে বেতারতরঙ্গ বাহিত হইয়া যে বক্তৃতা ভারতের প্রান্তে-প্রান্তরে পৌঁছাইয়াছিল, উদ্ধৃত কথাগুলি তাহারই অংশ। স্বাধীনতা-প্রাপ্তির মুহূর্তে নেহাতই আবেগের উচ্ছ্বাস? অথবা, রাজনৈতিক বানপ্রস্থে চলিয়া যাওয়া বৃদ্ধের প্রতি বাম হস্তে ছুড়িয়া দেওয়া ফুল? না কি, এই কথাগুলির মধ্যেই লুকাইয়া ছিল স্বাধীন ভারতের স্থপতিদের আন্তরিক বিশ্বাস? শুধু জওহরলাল নেহরুর নহে, ভীমরাও রামজি আম্বেডকরেরও বিশ্বাস, সুভাষচন্দ্র বসুরও বিশ্বাস? গোড়ায় স্বীকার করিয়া রাখা ভাল, যে অঙ্গীকারের সুরে ভারতের যাত্রা শুরু হইয়াছিল, ভারত সেই লক্ষ্যে পৌঁছাইতে পারে নাই। সেই ব্যর্থতা বহু অর্থে, বহু স্তরে— প্রান্তিকতম মানুষটির অশ্রুবিন্দু মুছিবার ‘অন্ত্যোদয়’ প্রতিশ্রুতির ক্ষেত্রেও। কিন্তু, সেই ব্যর্থতা সত্ত্বেও, তাঁহাদের চিন্তাসূত্রগুলি বলিয়া দেয় যে, কোন ভারতের কল্পনা তাঁহারা করিতেছিলেন। স্বাধীনতা লাভের পরে তো বটেই, তাহার ঢের পূর্বেও।
দেশ চালাইতে হইলে আর্থিক বৃদ্ধি প্রয়োজন, এই কথাটি সর্বকালের সর্বপ্রকার শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আর্থিক বৃদ্ধির অপরিহার্যতা বিষয়ে গাঁধীর সহিত জওহরলাল আদি নেতাদের যে তর্ক ছিল, এক অর্থে তাহা সনাতনতা বনাম আধুনিকতার তর্ক। সেই তর্কে জয়ী হইয়াছিল আধুনিকতার যুক্তি। বিপুল শিল্পায়নের মাধ্যমে, আধুনিক শিল্পকেন্দ্রিক উন্নয়নের পথে হাঁটিতে মনস্থ করিয়াছিল ভারত। সেই সিদ্ধান্ত লইবার জন্য অবশ্য ১৯৪৭ অবধি অপেক্ষা করিতে হয় নাই। ১৯৩৮ সালে, কংগ্রেস সভাপতি সুভাষচন্দ্র বসুর পৌরোহিত্যে গঠিত হইয়াছিল ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটি— রাজনৈতিক নেতারা নহেন, এই কমিটিতে মূল গুরুত্ব পাইয়াছিলেন বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা। রাজনীতির প্রাত্যহিকতা হইতে উন্নয়ন-পরিকল্পনাকে দূরে রাখিবার এই অভ্যাসটি স্বাধীন ভারতেও অনুসৃত হইয়াছিল। উন্নয়নের প্রক্রিয়াকে রাজনীতি-বিচ্ছিন্ন রাখা যায় কি না, রাখা উচিত কি না, সেই প্রশ্ন উঠিতেই পারে— কিন্তু এই সিদ্ধান্তকে অন্য এক ভাবেও পাঠ করা সম্ভব। রাজনৈতিক মত-নিরপেক্ষ ভাবে যে আর্থিক উন্নতি ও সার্বিক উন্নয়ন প্রয়োজন, এই কথাটি স্বাধীন ভারতের যাত্রারম্ভে স্বীকার করা হইয়াছিল।
কিন্তু, আর্থিক বৃদ্ধির অভিমুখে এই যাত্রা ভারতকে তৎকালীন অন্যান্য উপনিবেশ-উত্তর দেশ, বা পরবর্তী কালের ভারত হইতে পৃথক করে না। যাহা করে, তাহার নাম বণ্টনের সাম্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা— সেই সমতার ভিত্তিতে গড়িয়া উঠা রাষ্ট্রকল্পনা। কয়েক বৎসর পূর্বে অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটির গবেষণায় একটি তথ্য প্রকাশ পাইয়াছিল: বর্তমান পৃথিবীর যে আর্থিক সম্পদ, যে মোট উৎপাদনের পরিমাণ, সভ্যতার ইতিহাসে তাহা অভূতপূর্ব; কিন্তু, দুনিয়ায় আর্থিক অসাম্যের পরিমাণও শিল্পবিপ্লবের পরবর্তী কালে কখনও এত চড়া হয় নাই। অর্থাৎ, আর্থিক উৎপাদনের পরিমাণ বাড়িলেই তাহা নাগরিকের নিকট পৌঁছায় না, তাহার জন্য রাষ্ট্রকে পৃথক ভাবে প্রয়াস করিতে হয়। স্বাধীন ভারতের স্থপতিদের ভারতচিন্তায় যে বৈশিষ্ট্যটি এই দেশকে সমকাল ও ভবিষ্যতের দুনিয়ায় স্বতন্ত্র করিয়াছিল, তাহা হইল উৎপাদনের পাশাপাশি বণ্টনকে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান। স্বাধীনতার পর হইতে ১৯৮০’র দশকের গোড়া অবধি ভারতে আর্থিক অসাম্য কমিতেছিল, তাহার পর অসাম্য ফের ঊর্ধ্বমুখী— এই পরিসংখ্যানটির মধ্যে সেই ভারত-কল্পনার, এবং পরবর্তী সময়ে সেই রাষ্ট্রভাবনা হইতে বিচ্যুতির প্রতিফলন অনস্বীকার্য। প্রান্তিকতম মানুষটির চক্ষু হইতে শেষ অশ্রুবিন্দু মুছিবার অঙ্গীকারটি নেহাত কথার কথা ছিল না। নেহরু স্মরণ করাইয়া দিতেন, মুষ্টিমেয় মানুষের লাভের জন্য নহে, উৎপাদন বাড়াইতে হইবে মানুষের ভোগের পরিমাণ বৃদ্ধি করিবার জন্যই। এবং, সেই সম্পদের বণ্টনকে ক্রমাগত ন্যায্যতর হইয়া উঠিতে হইবে। বণ্টনের ন্যায্যতা নিশ্চিত হইতে পারে সুযোগের সমতা তৈরির মাধ্যমে। আম্বেডকর প্রশ্নটিকে দেখিতেন ভিন্ন দিক হইতে। তাঁহার মতে, সুযোগের ন্যায্য বণ্টন না ঘটিলে ক্ষতি শুধু পিছাইয়া পড়া মানুষেরই নহে, গোটা দেশের। নিছক নৈতিক ক্ষতি নহে, ক্ষতি উৎপাদনশীলতারও। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ হইতে, বিভিন্ন ভাবে স্বদেশভাবনার কেন্দ্রে প্রান্তিক মানুষকে রাখিতে পারাই ছিল সদ্য স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের অর্জন।