parliament

বেআব্রু

সংসদীয় প্রক্রিয়ার মর্যাদা রক্ষার দায়িত্বটি যদিও শাসক এবং বিরোধী উভয় পক্ষেরই, কিন্তু সেই দায়িত্ব সমান নয়। শাসক পক্ষ ক্ষমতাসীন, সেই কারণেই তার দায়িত্ব অনেক বেশি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০২৩ ০৬:১৮
Share:

সংসদ। ফাইল চিত্র।

বাজেট অধিবেশনটি কার্যত জলেই গেল। রাজনীতির ঘোলা জলে। মার্চ মাসে অধিবেশনের দ্বিতীয় পর্ব আরম্ভ হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন তরজায় অধিবেশন ব্যাহত হল। তা নিয়ে পারস্পরিক দোষারোপও চলছে। বিজেপির অভিযোগ, রাহুল গান্ধীকে বাঁচাতে কংগ্রেস যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকেও বিসর্জন দিতে রাজি, এই অধিবেশনে সে কথাটি প্রমাণ হয়ে গেল। অন্য দিকে, বিরোধীপক্ষের অভিযোগ, আদানি-প্রসঙ্গে যাতে কোনও মতেই আলোচনা না হতে পারে, তা নিশ্চিত করতেই শাসকপক্ষ রাহুল গান্ধীকে নিয়ে এমন বিপুল গোলমাল পাকিয়ে তুলল। কোন অভিযোগের কতখানি ভিত্তি রয়েছে, সেই তুল্যমূল্য বিচার করা অনাবশ্যক— কিন্তু, আদানি-কাণ্ডে শাসকপক্ষের চর্চিত নীরবতা দেখে কারও সন্দেহ হতেও পারে যে, সংসদে সেই প্রশ্ন আলোচিত না হতে পারা নিতান্ত সমাপতন নয়। উপরাষ্ট্রপতি ও রাজ্যসভার স্পিকার জগদীপ ধনখড় খেদোক্তি করেছেন যে, সংসদীয় প্রক্রিয়াকে রুদ্ধ করে যে ভাবে রাজনীতিকে অস্ত্র বানানো হয়েছে (ওয়েপনাইজ়িং অব পলিটিক্স), তা ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে গভীর দুঃসংবাদ বহন করে। কথাটির যাথার্থ্য নিয়ে প্রশ্ন চলতে পারে না। তবে, এখানে দু’টি কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন। প্রথম কথাটি তুলনায় গৌণ। তা হল, বর্তমান শাসকরা যখন বিরোধী অবতারে ছিলেন, তখন ‘২জি কেলেঙ্কারি’-র তদন্তে যৌথ সংসদীয় কমিটি গঠনের দাবিতে ২০১০ সালের শীতকালীন অধিবেশনটি তাঁরা সম্পূর্ণ অচল করে রেখেছিলেন। লোকসভা ও রাজ্যসভায় অধিবেশনের মেয়াদের যথাক্রমে ছয় ও আড়াই শতাংশ সময় কাজ হয়েছিল। পরিসংখ্যানটি বর্তমান বাজেট অধিবেশনের সঙ্গে তুলনীয়। অর্থাৎ, রাজনীতিকে অস্ত্র বানানোর অভিযোগটি যদি করতেই হয়, তবে সব দলের দিকে আঙুল তোলাই বিধেয়।

Advertisement

বড় কথাটি হল, সংসদীয় প্রক্রিয়ার মর্যাদা রক্ষার দায়িত্বটি যদিও শাসক এবং বিরোধী উভয় পক্ষেরই, কিন্তু সেই দায়িত্ব সমান নয়। শাসক পক্ষ ক্ষমতাসীন, সেই কারণেই তার দায়িত্ব অনেক বেশি। অধিবেশন চালু রাখার জন্য যে বিরোধী পক্ষের অন্যায় দাবিও মেনে নিতে হবে, তেমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু, বিরোধীপক্ষের সঙ্গে আলোচনার পরিসরটি খোলা রাখা দরকার। তাঁরা যে দাবিতে অনড়, তাকে যতটুকু জায়গা ছাড়া সম্ভব, তা ছেড়ে বিরোধীদেরও বোঝাতে হবে যে, সরকার তাদের থেকেও সহযোগিতা চায়। নির্বাচনী রাজনীতির মূল অস্ত্র সংঘাত বটে, কিন্তু সেই সংঘাত যে সংসদীয় গণতন্ত্রের চালিকাশক্তি হতে পারে না, এই কথাটি শাসকপক্ষের বোঝা প্রয়োজন— সেই উপলব্ধির প্রমাণ বিরোধীদের কাছে পেশ করা প্রয়োজন। কার্যত অকারণে বিরোধী দলের প্রধান নেতার সাংসদ পদ খারিজ করা হলে সেই সহযোগিতার পরিসরটি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।

এখানেই প্রশ্ন যে, বিজেপি কি আদৌ এই গণতান্ত্রিক পথটিতে হাঁটতে ইচ্ছুক? প্রধানমন্ত্রী যতই সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে সংসদ ভবনে প্রবেশ করুন না কেন, সংসদীয় প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে তিনি দৃশ্যত ইচ্ছুক নন। তাঁর সরকারও আলোচনার বদলে অধ্যাদেশের মাধ্যমে শাসনেই স্বচ্ছন্দ বোধ করেছে। বহু গুরুত্বপূর্ণ বিল পাশ হয়ে গিয়েছে বিন্দুমাত্র আলোচনা ব্যতিরেকেই। সংসদে বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রশ্নাতীত— ফলে, বিরোধী মতের তোয়াক্কা না করেই দেশ শাসন করা তাদের পক্ষে সম্ভব। কিন্তু, সেই অবস্থাতেও বিরোধীপক্ষকে তার প্রাপ্য গুরুত্ব দেওয়ার পরিণতমনস্কতার মধ্যেই গণতন্ত্রের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রমাণ নিহিত থাকতে পারত। বিজেপি এত দিন সচেতন ভাবে সেই পথ পরিহার করে এসেছে। ফলে সন্দেহ হতেই পারে যে, সাম্প্রতিক বাজেট অধিবেশনে সংসদ অচল থাকায় কী ক্ষতি হয়েছে, শাসকপক্ষ সে বিষয়ে উদাসীন। ভারতের দুর্ভাগ্য, যে সরকার এই দেশকে গণতন্ত্রের বিশ্বগুরু বলে প্রচার করে, সেই সরকারই গণতন্ত্রের আব্রু-রক্ষায় আগ্রহী নয়।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement