নির্বাচন কমিশন নির্দেশ দিয়াছে, অবিলম্বে পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত পেট্রল পাম্প হইতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ছবি সরাইয়া ফেলিতে হইবে। দুর্জনে বলিতেছে, এহেন নির্দেশে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নাকি হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিলেন— যখন প্রতি দিন পেট্রল-ডিজ়েলের দাম নূতনতর উচ্চতায় পৌঁছাইতেছে, তখন পেট্রল পাম্পেই সহাস্য প্রধানমন্ত্রীকে দেখিলে বিজেপির ভোট কমিবার সমূহ সম্ভাবনা ছিল! তুলনায় নিরাপদতর স্থান হইতে অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর ছবি সরে নাই। কোভিড-১৯’এর টিকাকরণের শংসাপত্রে তিনি স্বমহিমায় ভাস্বর। তৃণমূল কংগ্রেস এই বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগ জানাইয়াছে। রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের দিন ঘোষণা হওয়ায় আদর্শ আচরণবিধি চালু হইবার পরও কোভিড-১৯ টিকাকরণের ন্যায় একটি সর্বজনীন এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ছবি ব্যবহার করা চলে কি না, এই প্রশ্নটি উঠা স্বাভাবিক। শংসাপত্রে প্রধানমন্ত্রীর ছবি থাকিলে যে বিজেপির নির্বাচনী লাভ হইবে, তাহা প্রশ্নাতীত। ফলে, অবিলম্বে এই প্রচারটি বন্ধ করাই বিধেয়। অন্য কোনও ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীর ছবি ব্যবহার করিয়া সরকারি প্রকল্প বা অন্য কিছুর প্রচার হইলে তাহাও বন্ধ করা জরুরি। তবে, নির্বাচন কমিশন স্বপ্রবৃত্ত হইয়া এই কাজটি করিবে না কেন, এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় নাই।
বৃহত্তর প্রশ্নটি হইল, এত ছবি কেন? ২০১৫ সালে সুপ্রিম কোর্ট একটি নির্দেশে জানাইয়াছিল, সরকারি অর্থব্যয়ে প্রকাশিত বিজ্ঞাপনে কোনও নেতা-মন্ত্রীর ছবি দেওয়া চলিবে না। কেন্দ্রীয় সরকার, এবং বেশ কয়েকটি রাজ্য সরকারের আবেদনের ভিত্তিতে সেই আয় পুনর্বিবেচনা করিয়া ২০১৬ সালে শীর্ষ আদালত জানায়, প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, এবং কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের মন্ত্রীদের ছবি বিজ্ঞাপনে দেওয়া চলিবে। তাহার ফলে, শুধু পেট্রল পাম্পে বা কোভিড-১৯’এর টিকার শংসাপত্রে নহে, কার্যত প্রতিটি রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের সংবাদই সাধারণ মানুষের নিকট পৌঁছায় নেতা-মন্ত্রীদের মুখচ্ছবি সমেত। এই মুহূর্তে বিশ্বের অধিকাংশ দেশে কোভিড-১৯ টিকাকরণ কর্মসূচি চলিতেছে। টিকা লইলে শংসাপত্রও মিলিতেছে। দেশগুলিতে প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্টরাও আছেন— অনেক দেশেই গণতান্ত্রিক পথে নির্বাচিত সর্বাধিপত্যকামী শাসকও আছেন। কিন্তু, নেতার চিত্র-শোভিত শংসাপত্র বস্তুটি নাই। সর্বোচ্চ নেতার ছবিটি ছাপা না হইলে টিকা ঠিক মতো কাজ করিবে কি না, এই সংশয় শুধুই ভারতের!
সরকারি অর্থব্যয়ে নেতাদের আত্মপ্রচারের বহরটি কতখানি? নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম দফায় বিজ্ঞাপন বাবদ ব্যয় হইয়াছিল প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা। অঙ্কটি কত বড়, একটি তুলনায় তাহা বোঝা সম্ভব— বিধ্বংসী আমপান ঝড়ের ক্ষতিপূরণ বাবদ কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গকে মোট ৩৭০৮ কোটি টাকা দিয়াছে। বিজ্ঞাপন বাবদ এই বিপুল ব্যয় কেন জরুরি, তাহার অনিবার্য উত্তর হইল— সাধারণ মানুষকে সরকারি প্রকল্প সম্বন্ধে অবহিত করিবার জন্য। সেই গণজ্ঞাপনের জন্য তো নেতা-মন্ত্রীদের ছবি লাগে না। তাঁহারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, সরকারি অর্থের অছিমাত্র। মালিক নহেন। যে কোনও রাষ্ট্রীয় প্রকল্পই চলে রাষ্ট্রের তরফে, রাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য, এবং নাগরিকের অর্থে— মন্ত্রী বা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বদান্যতা বা অনুগ্রহে নহে। আগামী দফায় তাঁহারা নির্বাচিত না হইলেও রাষ্ট্রের সহিত নাগরিকের এই আদানপ্রদানের সম্পর্কটি বদলাইয়া যাইবে না। অথচ নেতারা সম্ভবত বিশ্বাস করেন যে, তাঁহারা জনপ্রতিনিধি নহেন, রাজা। জনগণও যাহাতে তাঁহাদের সেই চোখেই দেখে, তাহা নিশ্চিত করিতেই এহেন বিজ্ঞাপনের প্রাবল্য। শুধুমাত্র নির্বাচনী আচরণবিধির বাধ্যবাধকতাতেই নহে, এই প্রবণতাটি সামগ্রিক ভাবে বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। অবিলম্বে।