Coronavirus in West Bengal

সঙ্কল্পের দিন

কোভিডের মতোই, বিদ্বেষ ও কুরুচির এই ভয়াবহ ব্যাধির প্রতিরোধেও শেষ অবধি ভরসা নাগরিকের শুভবুদ্ধি এবং তাহা প্রয়োগের উদ্যম।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০২১ ০৫:১২
Share:

প্রতীকী ছবি।

এক বছর আগে ১৪২৭ বঙ্গাব্দের প্রভাতে এই স্তম্ভে লেখা হইয়াছিল, ‘বর্ষসূচনার এমন রূপ আগে কখনও দেখা যায় নাই, আর কখনও যেন দেখিতে না হয়।’ কোভিড-১৯ অতিমারি তখন নবাগত। জনজীবন কার্যত সম্পূর্ণ স্তব্ধ। সংক্রমণের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা যতটা অস্পষ্ট, জল্পনা ততটাই প্রবল। আতঙ্ক সেই অনুপাতেই বিপুল। দেখিতে দেখিতে বাংলা ১৪২৮ সাল সমাগত। মধ্যে কিছু কাল প্রশমিত থাকিবার পরে দেশে কোভিড সংক্রমণের হার গত বৎসরের তুলনায় বেশি, প্রতি দিন নূতন আক্রান্তের সংখ্যা রেকর্ড ভাঙিয়া চলিয়াছে। মৃত্যুসংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী। অতিমারির ভারতীয় মানচিত্রে যে রাজ্যগুলিতে বিপদসঙ্কেত জ্বলিতেছে, পশ্চিমবঙ্গ তাহাদের অন্যতম। কলিকাতা-সহ অনেকগুলি জেলার পরিস্থিতি গভীর উদ্বেগের কারণ। কিন্তু জনজীবনে আতঙ্কের ভাব গত বৎসরের তুলনায় অনেক কম। দৃশ্যত, বহু নাগরিক নিয়তির হাতে আপনাকে এবং সহনাগরিকদের সমর্পণ করিয়া সম্পূর্ণ বেপরোয়া ভাবে ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন। ভোটের প্রচার জনসমাবেশে এক অস্বাভাবিক মাত্রা যোগ করিয়াছে। ফলে, ‘বর্ষসূচনার এমন রূপ... আর কখনও যেন দেখিতে না হয়’— এমন আশার বাণী উচ্চারণের উপায় আজ আর নাই। এই শুভদিনে অবশিষ্ট দেশ ও দুনিয়ার সহিত পশ্চিমবঙ্গবাসী কেবল এইটুকুই প্রার্থনা করিতে পারেন যে, সকলের শুভবুদ্ধি জাগ্রত হউক, এই বিপদের মোকাবিলায় সমস্ত প্রকারে প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন সম্পর্কে সমাজের প্রতিটি মানুষের সম্বিৎ ফিরুক।

Advertisement

শুভবুদ্ধির প্রয়োজন কেবল অতিমারির মোকাবিলায় নহে, রাজনীতি এবং সমাজের কালব্যাধির বিরুদ্ধেও। বিধানসভা নির্বাচনের মরসুমে নববর্ষ আসিয়াছে, সুতরাং তাহার পরিবেশে কিছু বাড়তি কলুষ থাকিবে, তাহা বোধ করি অনিবার্য, কারণ অনেক দিন যাবৎ এই দেশে নির্বাচন সমুৎপন্ন হইলে বিবিধ রাজনৈতিক জীবাণু অতিসক্রিয় হইয়া উঠে। কিন্তু এই বারের নির্বাচনী পশ্চিমবঙ্গে যাহা ঘটিয়া চলিয়াছে তাহা নিছক সংক্রমণ নহে, কুৎসিত এবং হিংস্র অ-সভ্যতার এক অভূতপূর্ব, অদৃষ্টপূর্ব এবং অকল্পিতপূর্ব অতিমারি। এই গরলের কতটা বহিরাগত আর কতখানি দেশজ সেই বিতর্ক থাকুক, কিন্তু অনেক বেশি ভয়ানক সত্য ইহাই যে, বাঙালি সমাজের শিরায় ও ধমনীতে গরলের সঞ্চার উত্তরোত্তর প্রবল হইয়া উঠিতেছে, দিনের পর দিন তাহার উৎকট মূর্তি দেখিয়া যে কোনও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিক লজ্জায় ঘৃণায় এবং ভয়ে কুঁকড়াইয়া যাইতেছেন। নির্বাচনী প্রচারের মঞ্চ হইতে অষ্টপ্রহর যে বিষাক্ত আবর্জনা সমাজের উদ্দেশে বর্ষিত হইতেছে, জনমনে তাহার ক্ষতিকর প্রভাব— পারমাণবিক বিক্রিয়ার মতোই— দীর্ঘকাল ধরিয়া জারি থাকিতে পারে।

কোভিডের মতোই, বিদ্বেষ ও কুরুচির এই ভয়াবহ ব্যাধির প্রতিরোধেও শেষ অবধি ভরসা নাগরিকের শুভবুদ্ধি এবং তাহা প্রয়োগের উদ্যম। বস্তুত, বাহিরের ভাইরাসের প্রকোপ আপনার নিয়মেই ক্রমশ কমিয়া আসিবে বলিয়া মনে করিবার যতটা ভরসা আছে, অন্তরের ভাইরাসের ক্ষেত্রে তাহার সিকিভাগ ভরসাও নাই। প্রতিকার ও নিরাময়ের প্রবল উদ্যোগ না করিলে এই ব্যাধি দ্রুত বাড়িবে এবং সমাজকে উত্তরোত্তর গ্রাস করিবে, তাহাতে কিছুমাত্র সংশয় নাই। বাঙালি তাহার ইতিহাসে বহু বিপদ অতিক্রম করিয়াছে, এই বিপদও সে জয় করিবার সামর্থ্য রাখে। বঙ্গসমাজে যে উদার বহুত্ববাদের ধারা আজও সচল, বাংলা নববর্ষ তথা বর্ষগণনার নিয়মটি নিজেই যে বহুত্বের সৃষ্টি, তাহাই সঙ্কীর্ণ বিদ্বেষের হিংস্র আগ্রাসন হইতে আমাদের রক্ষা করিতে পারে। সেই সামর্থ্যকে জাগ্রত করিবার জন্য, আপন সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রত্যয়ে ঘুরিয়া দাঁড়াইবার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগই এখন অত্যাবশ্যক। নববর্ষের এই দিনটি সেই সঙ্কল্পের দিন।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement