— ছবি সংগৃহীত
জামিনে মুক্ত, কিন্তু মুক্তি মিলিল কি? ঢাকার সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা বহাল রাখিয়াছে বাংলাদেশ সরকার। সরকারের নানা দফতরের, বিশেষত কোভিড-মোকাবিলা ও টিকাকরণ লইয়া স্বাস্থ্য মন্ত্রকের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কলম ধরিয়া বিরাগভাজন হইয়াছিলেন এই সাংবাদিক, ঘটনাচক্রে তাঁহাকে সচিবালয়ে পাইয়া কয়েক ঘণ্টা আটকাইয়া কয়েক জন আমলা হেনস্থা করেন বলিয়া অভিযোগ। থানায় মামলা হয়, রোজিনা নাকি সরকারি নথি ও তথ্য চুরি করিয়াছেন! পুলিশ আসিয়া তাঁহাকে থানায় লইয়া যায়, পরে গ্রেফতার করিয়া আদালতে তোলে। ছয় দিন জেল হেফাজতে কাটাইয়া জামিনে মুক্তি পাইয়াছেন রোজিনা, ইতিমধ্যে তাঁহার সমর্থনে সরব নাগরিক ও সাংবাদিক-সমাজ, পাশে দাঁড়াইয়াছে রাষ্ট্রপুঞ্জ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানবাধিকার সংস্থা। বাংলাদেশ সরকার ভাঙিলেও মচকায় নাই, মামলা বিচারাধীন হওয়া সত্ত্বেও তথ্যমন্ত্রীর ইঙ্গিত, রোজিনা অপরাধী।
ঘটনাটি বাংলাদেশের, কিন্তু সমগোত্রীয় উদাহরণ দেখা যাইবে পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভারত-সহ সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াতেই। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে এই দেশগুলির ক্রমাবনতি যদি তাত্ত্বিক প্রমাণ হইয়া থাকে, প্রায়োগিক প্রমাণ মিলিবে প্রতিটি দেশে সাংবাদিকদের কাজে বাধা দান, হেনস্থা, অত্যাচার, গ্রেফতার এমনকি হত্যার ঘটনায়। ছকটি পরিচিত: সরকারের সমালোচনামূলক বা ভাবমূর্তি-বিরোধী কিছু লিখিলে ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’র অপরাধে, কড়া সরকারি আইনে সাংবাদিকদের গ্রেফতার ও কারাবন্দি করা। অতিমারিকালে এই সমস্তই আরও কঠোর হইয়াছে, কোভিড-বিধির কড়াকড়িকে ঢাল করিয়া সাংবাদিকদের সংবাদ সংগ্রহে, অবাধ যাতায়াত ও অনুসন্ধানে বাধা দেওয়া হইয়াছে, তথ্য-পরিসংখ্যান জোগাড়ে মিলিয়াছে অসহযোগ, আর কোভিড-মোকাবিলায় সরকারি গাফিলতি, ব্যর্থতা বা দুর্নীতি বিষয়ে সরব হইলে তো কথাই নাই। ইহার বাহিরেও শাসক ও বিরোধী দলের দ্বৈরথ, কিংবা একই দলের দুই যুধ্যমান গোষ্ঠীর কোন্দল লইয়া খবর করিতে গিয়া এই দেশগুলিতে কত সাংবাদিক আহত ও নিহত হইয়াছেন, তাহার ইয়ত্তা নাই। রাজনৈতিক নেতার সরকারি অর্থ তছরুপ, চাল, গ্যাস সংযোগ, ত্রাণ লইয়া দুর্নীতি, মাদক কারবার লইয়া খবর করিতে গিয়া সাংবাদিকদের বিপদে পড়িতে হইয়াছে, সমাজমাধ্যম ভরিয়াছে নারী সাংবাদিকদের চরিত্রহনন ও প্রাণে মারিবার হুমকিতে।
আলাদা করিয়া বলিতে হয় ভারতের কথা। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে তাহার স্থান ১৪২, ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স’ সংস্থার মতে, সাংবাদিকদের জন্য ‘বিশ্বের সর্বাপেক্ষা বিপজ্জনক’ দেশগুলির একটি ভারত। যে দেশের প্রধানমন্ত্রী কদাপি সাংবাদিক সম্মেলন করেন না, গণতন্ত্র রক্ষায় সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার গুরুত্ব তিনি বুঝিবেন, আশা করা বৃথা। তাই দলিত নারীর গণধর্ষণের খবর করিতে যাওয়া সাংবাদিক ইউএপিএ আইনে আজও কারাবন্দি, ৩৭০ ধারা অবলোপ-উত্তর কাশ্মীরে নয়া নীতির জেরে সংবাদমাধ্যমের নাভিশ্বাস উঠিয়াছে। বাংলাদেশের রোজিনার দৃষ্টান্ত এই দেশে অগণন। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাহীনতা যে গণতন্ত্র নহে, আধিপত্যবাদী একনায়কতন্ত্রের চরিত্রবৈশিষ্ট্য, ভারতের তাহা বুঝা দরকার।