ফাইল চিত্র।
অবশেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অনুরোধে, রামদেব নিজের মন্তব্য প্রত্যাহার করিয়া লইলেন। প্রসঙ্গটি সেখানেই ফুরাইয়া যাইতে পারিত। বস্তুত, অতিমারির গোটা সময়কাল জুড়িয়া যে ব্যক্তি অপবিজ্ঞান চর্চা ও প্রচার করিয়া আসিয়াছেন, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও চিকিৎসকদের বিষয়ে তাঁহার বোধহীন মন্তব্যকে কোনও গুরুত্ব না দিলেও চলিত। কিন্তু, রামদেব সমস্যা নহেন। তিনি বড় জোর সেই সমস্যার একটি বহিঃপ্রকাশ মাত্র। সমস্যা মানসিকতায়— ভারতের বর্তমান শাসকরা তাঁহাদের অন্তরে যে মানসিকতা বহন করিয়া চলেন, সমস্যা তাহাতে। সেই মানসিকতাটি কোনও বিশেষ বিকৃতি নহে, তাঁহাদের রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বিজেপি-আরএসএস’এর রাজনীতির মূল প্রতিপাদ্য হইল হিন্দুত্বের গৌরব প্রতিষ্ঠা। তাহার জন্য যেমন ‘হিন্দু’ কৃতিত্বের সত্য, অর্ধসত্য বা সম্পূর্ণ কল্পিত উদাহরণ খুঁজিয়া বাহির করিতে হয়, অন্য দিকে অস্বীকার করিতে হয় অগ্রগতির অন্যান্য যাবতীয় লক্ষণকে। বঙ্গে যখন নবজাগরণের আলোক প্রস্ফুটিত হইতেছিল, তখন বিবিধ টোল হইতে তাহাকে প্রতিরোধ করিবার চেষ্টাও হইয়াছিল— সনাতন সংস্কৃতির দোহাই পাড়িয়াই। বাংলার সৌভাগ্য, ভারতেরও— তখন সমাজে এমন মানুষ ছিলেন, যাঁহারা এই পুরাতনের প্রতি টানকে অগ্রাহ্য করিয়া নূতনকে দেহে এবং মনে বরণ করিয়া লইতে পারিয়াছিলেন। কিন্তু, ঔপনিবেশিক সময়ে হিন্দুত্বের পুনরুত্থানের রাজনীতি সাক্ষী, নবজাগরণ-লব্ধ আলোকে অজ্ঞানতার তামসে নিমজ্জিত করিবার প্রচেষ্টা কখনও থামে নাই। আজিকার বিজেপি-আরএসএস সেই ঐতিহ্যেরই ধারক-বাহক।
প্রধানমন্ত্রীর কুর্সি হইতে বিভিন্ন সময়ে নরেন্দ্র মোদী এমন বহু কথা বলিয়াছেন, যাহা তুমুল হাসির খোরাক হইতে পারে। গণেশের প্লাস্টিক সার্জারি, পুষ্পক রথই প্রথম বিমান গোত্রের কথাগুলিকে কেহ তাঁহার শিক্ষার অভাব বলিয়াও ব্যাখ্যা করিতে পারেন। কিন্তু, সেই ভাবে দেখিলে এই কথাগুলির রাজনৈতিক তাৎপর্য অধরাই থাকিয়া যাইবে। প্রধানমন্ত্রীর উচ্চাসন হইতে এই ছদ্ম-বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা যদি ধারাবাহিক ভাবে আসিতেই থাকে, তবে দেশের মানুষের একটি বড় অংশকে বিভ্রান্ত করিয়া দেওয়া সম্ভব— কোনটি ঠিক, কোনটি ভুল, সেই বোধ গুলাইয়া দেওয়া সম্ভব। তাহার পর যদি পাঠ্যক্রমে ‘বৈদিক বিজ্ঞান’ বা ‘বৈদিক গণিত’ ঢুকাইয়া দেওয়া হয়, অধিকাংশ মানুষই তাহাকে হিন্দুত্বের প্রকল্পের অংশ হিসাবে চিহ্নিত করিতে পারিবেন না। প্রশ্ন করিবেন না যে, বেদ হইতে যাহা শিক্ষণীয় ছিল, আধুনিক বিজ্ঞান বহু পূর্বেই তাহাকে আত্মস্থ করিয়াছে— এখন আবার আলাদা করিয়া স্কুল-কলেজ স্তরে বৈদিক বিজ্ঞানের চর্চা কেন? কেহ বেদ চর্চা করিতেই পারেন— সেই চর্চার গুরুত্ব অনস্বীকার্য— কিন্তু, তাহাকে স্কুলপাঠ্য বিজ্ঞানের মোড়ক দেওয়া হইল হিন্দুত্বের চিন্তা-আধিপত্য বিস্তার। তাহাই এই রাজনীতির প্রধানতম উদ্দেশ্য।
রামদেব ও তাঁহার মন্তব্য এই চিন্তা-আধিপত্যেরই ফসল। দেশে এমন পরিবেশ সৃষ্টি হইয়াছে, যেখানে জনসমক্ষে বিজ্ঞানকে আক্রমণ করাকে সমাজের একটি অংশ ‘বৈধ’ হিসাবেই দেখে। যেন বিজ্ঞান ও অপবিজ্ঞানের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা বা গুরুত্বের কোনও তারতম্য নাই। যেন কোনটি ঠিক আর কোনটি ভুল, তাহা লইয়া ন্যায্য তর্ক চলিতেই পারে। গত দেড়শত বৎসরে ভারত যাহা অর্জন করিয়াছিল, তাহার সমস্তই বিসর্জন দিবার প্রকল্প বর্তমান শাসকদের ছিল। নাগরিকদের একাংশের নিকট গোমূত্র সেবন বা গোময় লেপন অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসার প্রকৃষ্ট বিকল্প হিসাবে স্বীকৃতি পাইতেছে, তাহা সেই প্রকল্পের সাফল্যেরই প্রমাণ। আসল বিপদ এখানেই। রামদেব তাঁহার অবিবেচনাপ্রসূত মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চাহিলেন কি না, তাহাতে কিছু আসে যায় না। শাসকদের হিন্দুত্ব প্রকল্প দেশকে ক্রমশ পিছাইয়া দিতেছে, তাহাই মূল বিবেচ্য।