Media

সরকারের সীমা

সরকার তথা শাসক দলের প্রতিকূল সংবাদ প্রকাশের পরেই সাংবাদিককে মামলায় জড়িয়ে ফেলার চেষ্টাটি পরিচিত। গত বছর জানুয়ারিতে নবদ্বীপে আট জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এফআইআর করেছিল পুলিশ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০২৪ ০৭:৩৯
Share:

—প্রতীকী ছবি।

সন্দেশখালিতে কর্মরত সাংবাদিককে গ্রেফতারের ঘটনায় এ রাজ্যে সাংবাদিক-হেনস্থার নতুন নজির স্থাপিত হল। সংবাদ চ্যানেলের ওই সাংবাদিক অবিলম্বে জামিন পেয়েছেন, কলকাতা হাই কোর্ট সরকারকে ভর্ৎসনাও করেছে। অন্য দিকে, একটি সংবাদ চ্যানেলের শীর্ষ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে তদন্তে স্থগিতাদেশ জারি করে কলকাতা হাই কোর্ট রাজ্য পুলিশকে ভর্ৎসনা করল, এবং সংবাদমাধ্যমকে স্বাধীন ভাবে ও নির্ভয়ে কাজ করতে দেওয়ার গুরুত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিল। দুর্নীতিতে অভিযুক্তদের দিকে মন না দিয়ে সাংবাদিকের গ্রেফতারে কেন মনঃসংযোগ, তৃণমূল সরকারের প্রতি আদালতের এই প্রশ্ন বস্তুত রাজ্যবাসীরই মনের প্রশ্ন। তবে এই ঘটনাকে আকস্মিক বলা চলে না। কোনও সংবাদ প্রতিবেদন রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে গেলে আচমকা গ্রেফতার হতে পারেন সাংবাদিক, এমন ঘটনা এই রাজ্যে সম্প্রতি কালে ঘটতে দেখা গিয়েছে। গত বছর সেপ্টেম্বরে বাংলা দৈনিকের সাংবাদিক এমনই অকস্মাৎ গ্রেফতার হয়েছিলেন। তাঁর কয়েকটি রিপোর্ট খড়্গপুরে অবৈধ মদের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে পুলিশের ব্যর্থতা ও নিষ্ক্রিয়তা স্পষ্ট করে দিয়েছিল। প্রতিবেদন প্রকাশের ন’দিনের মাথায় গভীর রাতে পুলিশ তাঁর বাড়িতে হানা দিয়ে ওই সাংবাদিককে গ্রেফতার করে। তিনিও জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। কারও বিরুদ্ধে গুরুতর কোনও অভিযোগ থাকলে অবশ্যই তার যথাযথ তদন্ত প্রয়োজন। তবু একটি প্রশ্ন থেকেই যায়: সাংবাদিককে কিছুমাত্র জিজ্ঞাসাবাদ না করে, আত্মপক্ষ সমর্থন কিংবা আইনি পরামর্শ নেওয়ার কোনও সুযোগ না দিয়ে, অকস্মাৎ গ্রেফতার এবং হাজতবাস— এর মধ্যে কি একটা নির্দিষ্ট ছক দেখতে পাওয়া যায় না?

Advertisement

সরকার তথা শাসক দলের প্রতিকূল সংবাদ প্রকাশের পরেই সাংবাদিককে মামলায় জড়িয়ে ফেলার চেষ্টাটি পরিচিত। গত বছর জানুয়ারিতে নবদ্বীপে আট জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এফআইআর করেছিল পুলিশ। তাঁরা সকলেই নবদ্বীপ পুরসভার দুর্নীতির বিষয়ে খবর করেছিলেন। নেতার মানহানি, রাজ্যের ভাবমূর্তিতে আঘাত, ভুয়ো খবর ছড়ানো থেকে শুরু করে মেয়েদের শ্লীলতাহানি, নানা অভিযোগ আরোপ করা হচ্ছে সাংবাদিকের উপরে। মামলা করার আগে, বা গ্রেফতারের আগে পুলিশ যে ঘটনার প্রাথমিক তদন্ত করেছে, সে বিষয়েও আশ্বস্ত হওয়া যাচ্ছে না। ফলে সন্দেহ জাগছে, এ কি আইনের শাসন, না কি রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতের অস্ত্র হিসাবে আইনের ব্যবহার? অবশ্য বেআইনি ‘দাওয়াই’ প্রয়োগেও কুণ্ঠা দেখা যায়নি সন্দেশখালিতে— ইডির তদন্ত দলের সঙ্গী সাংবাদিকরা তৃণমূল নেতা শেখ শাহজাহানের অনুগামীদের হাতে প্রহৃত, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তার পরেও সন্দেশখালিতে গিয়েছেন সাংবাদিকরা, সেখানকার নৈরাজ্যের ছবি সামনে এনেছেন।

সাংবাদিকরা চিরকাল ব্যক্তিগত ঝুঁকি নিয়েই পেশাগত কাজ করতে যান। আক্ষেপ এই যে, সাংবাদিক-নিপীড়নের নিরিখে তৃণমূল আর তার প্রধান প্রতিপক্ষ বিজেপির মধ্যে সীমারেখাটিও সহসা ঠাহর করা যাচ্ছে না। দু’টি দলই সংবাদের স্বাধীনতার প্রতি অসহিষ্ণু, সাংবাদিক-নিপীড়নে দ্বিধাহীন, প্রশাসনিক স্বচ্ছতায় অনাগ্রহী, বিভ্রান্তিকর পরিসংখ্যান প্রচারে পারদর্শী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নানা সময়ে সাংবাদিকের প্রশ্নে উষ্মা প্রকাশ করেছেন, প্রশ্নরত সাংবাদিককে ‘বিরোধী’ বলে দাগিয়ে দিয়েছেন, অপছন্দের সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকার করেছেন। পাশাপাশি, কিছু সাংবাদিককে নিয়ে নিজের চার পাশে একটি বৃত্ত তৈরি করেছেন। তা সত্ত্বেও সাংবাদিক সহকর্মীর গ্রেফতারের পরে সারা রাজ্যের সাংবাদিকরা সমস্বরে প্রতিবাদ করেছেন, আদালতও দাঁড়িয়েছে সাংবাদিকের অধিকার, তথা বাক্‌স্বাধীনতার অধিকারের পাশে। সংবাদের স্বাধীনতার সীমা যত বার টানার চেষ্টা করা হবে, সাংবাদিকরা তত বারই সরকারকে ক্ষমতার সীমা মনে করাবেন, এটাই গণতন্ত্রের বাস্তব।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement